মানুষ বন্ধক রেখে ইয়াবার কারবার

  বিশেষ প্রতিনিধি    22-05-2023    89
মানুষ বন্ধক রেখে ইয়াবার কারবার

নগদ টাকা না থাকলে তার বদলে মানুষকেই পণ রেখে এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবার চালান পাঠাচ্ছে মাদক কারবারিরা। অনুসন্ধান করতে গিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার ইয়াবা কারবারিদের নতুন এই কৌশল সম্পর্কে জানা গেছে। ব্যবসা বিস্তারের জন্য তারা এ পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। কথিত আছে, এই কৌশলের পরিকল্পনাকারী মূলত মিয়ানমারের ইয়াবা কারবারিরা। তাদের তত্ত্বাবধানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপদে ব্যবসা করে চলেছে মাদক কারবারিরা। বিভিন্ন সূত্রমতে, কেবল কক্সবাজারেই বর্তমানে দুই হাজারের বেশি ব্যক্তি ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত।

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী মাদক কারবারিদের ইয়াবা ব্যবসা তুঙ্গে উঠেছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে পাচারের নিত্যনতুন চক্র তৈরি করছে তারা। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে প্রতিদিন লাখ লাখ ইয়াবা পৌঁছে যাচ্ছে স্থানীয় মাদক কারবারিদের হাতে। কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকার একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের ইয়াবা কারবারের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা কৌশল বেছে নিচ্ছে মিয়ানমারের ইয়াবা কারবারি ও কারখানার মালিকরা। বেশ কয়েক মাস ধরে ইয়াবার চালান নিতে আসা কারবারিদের কাছে বাকিতেও ইয়াবা সরবরাহ করছে তারা। তবে বাকি অর্থের জন্য পণ করে রাখছে চালান নিতে আসা ব্যক্তির রেখে যাওয়া মানুষকে। এই অর্থ সঠিক সময়ে পরিশোধ না করলে পণ রাখা মানুষটিকে আটকে রাখা হচ্ছে। তার ওপর নির্যাতন চালিয়ে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে বাকি টাকা আদায় করা হচ্ছে। সরেজমিন অনুসন্ধান ও পুলিশের বিভিন্ন মামলা পর্যালোচনায় এসব তথ্য মিলেছে।

আরিফকে পণ রেখে ইয়াবা আনেন সুমন

মানুষ পণ রেখে ইয়াবা ব্যবসার ঘটনা পুলিশের সামনে আসে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। আরিফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে তার বন্ধু মো. সুমন পণ রেখে দুই লাখ টাকার ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় আসেন। নির্ধারিত সময়ে টাকা নিয়ে না যাওয়ায় আরিফকে আটকে রাখা হয়।

পরে বিষয়টি থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। আরিফকে উদ্ধারের পর পুলিশ জানতে পারে, তার বন্ধু সুমন তাকে পণ রেখে ইয়াবার একটি চালান ঢাকায় এনে বিক্রি করেন। কিন্তু তার ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি ঠিক সময়ে যেতে পারেননি কিংবা যাননি। এজন্য আরিফকে আটকে রাখা হয় এবং তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। পুলিশের ধারণা, সঠিক সময়ে ইয়াবার টাকা পেলে বিষয়টি জানাজানি হতো না।

পরে এ ঘটনায় আরিফ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় মামলা করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, সাভার পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুখার্জিপাড়ার সিরাজুল ইসলামের ছেলে আরিফুল। ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার শুভাঢ্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. সুমনের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে কক্সবাজারের টেকনাফ বেড়াতে যান তিনি। সেখানে সুমনের পূর্বপরিচিত টেকনাফ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নিজামুদ্দিনের বাড়ির ভাড়াটে সলিমুল্লাহর বাসায় ওঠেন তারা।

পরে সলিমুল্লাহর কাছে আরিফকে পণ রেখে সুমন দুই লাখ টাকার ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। দুই-তিন দিন পেরিয়ে গেলেও আরিফকে আর ছাড়াতে যাননি সুমন। পরে পুলিশ টেকনাফের একটা তালাবদ্ধ ঘর থেকে তাকে উদ্ধার করে।

এ ঘটনা সম্পর্কে আরিফুলের স্ত্রী শামিমা আফরোজ জানান, তার স্বামী গার্মেন্টসে চাকরি করেন। চাকরি দেওয়ার কথা বলে সুমন তাকে টেকনাফ নিয়ে যান। সেখানে তাকে বন্ধক রেখে ইয়াবা নিয়ে ঢাকা চলে আসেন সুমন। প্রথম দুই দিন তার স্বামীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হলেও পরে আর যথাযথ আচরণ করা হয়নি। তার সঙ্গেও যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো না। পরে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হলে র‌্যাব-পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে তাকে।

টেকনাফ থানার ওসি আব্দুল হালিম জানান, ঢাকার সাভার থেকে খবর আসে আরিফ নামের এক ব্যক্তি ঘুরতে এসে স্থানীয়দের হাতে বন্দি আছেন। পরে তাকে উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় আরিফ অপহরণ মামলা করেছেন। শুধু সুমন নয়, এমন আরও অনেকে পণ হিসেবে মানুষ রেখে কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান এনে বিক্রি করছে। আর্থিক ঝামেলা হচ্ছে না বলে পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ আসছে না বলেও মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তা হালিম।

নিজে জিম্মি হয়ে ইয়াবা পাঠান রাকিব

গত ৭ মে নিজেকে পণ রেখে ঢাকায় ইয়াবার চালান পাঠান রাকিব আহম্মেদ। তিনি মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গিবাড়ী থানার স্বর্ণগ্রামের বাসিন্দা। রাজধানীর একাধিক থানাসহ বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে চারটি মাদক মামলা রয়েছে। কারাগারে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় মেহেদী হাসান নয়ন নামের একজনের সঙ্গে। ময়মনসিংহ কারাগার থেকে জামিনের পর নয়ন তাকে আশ্রয় দেন নিজের বাড়িতে। পরে নয়ন রাকিবকে টেকনাফে ফয়সাল নামের একজনের কাছে পাঠান।

তাদের মধ্যে কথা হয়, রাকিব জিম্মা হিসেবে থাকলে ইয়াবা দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী রাকিব ৭ মে টেকনাফ যান এবং তাকে জিম্মায় রেখে ইয়াবার একটা চালান ফয়সাল ঢাকা পাঠান। কথা ছিল, ইয়াবা বিক্রি করে মূল্য পরিশোধ করা হবে। কিন্তু ইয়াবা পাওয়ার পর নয়ন আর যোগাযোগ করেননি।

ফলে রাকিবকে আটকে রাখা হয়। ১০ মে রাকিব কৌশলে পালিয়ে টেকনাফের একটা গ্রামে আশ্রয় নিলে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মাদক মামলা করা হয়। অন্যদিকে রাকিবকে দিয়ে অপহরণ মামলা করানো হয় নয়ন ও ফয়সালের নামে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া জানান, একসময় টাকা দিয়ে মাদক বা ইয়াবা নেওয়া হতো। এখন দুজন মানুষ টেকনাফ বা উখিয়ায় যায়, টাকার বদলে একজনকে পণ রেখে ইয়াবা নিয়ে আসে। ইয়াবা দেওয়ার সময় বলা হয়, বিক্রি করে টাকা সঠিক সময় না দেওয়া হলে জিম্মি রাখা মানুষকে হত্যা করা হবে। এটা ব্যবসার নতুন কৌশল। এসব এখনই বন্ধ করা জরুরি। তিনি আরও জানান, যারা উদ্ধার হয়েছে তারা কার মাধ্যমে টেকনাফ গেছে, কে পণ রেখে ইয়াবা দিয়েছে, তাদের সম্পর্কে অনুসন্ধান করে সবার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

যার হাত ধরে ইয়াবার বিস্তার

আশির দশকের শেষদিকে দেশে ইয়াবার কারবার শুরু হয়। কিন্তু দেশের মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে ইয়াবা ব্যবসার বিষয়টি আসে আরও অনেক পরেÑ ২০০৫ সালের শেষের দিকে। ১৯৯৪ সাল থেকে ইয়াবার চালান মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে ঢাকা আসতে শুরু করে। তখন ইয়াবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তেমন কিছু জানত না। সে সময় ভারতীয় ফেনসিডিল, পেথেডিন ইনজেকশন, হেরোইন ও গাঁজা পাওয়া যেত।

এরশাদের আমলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উচ্চবিত্তদের টার্গেট করে মাদক কারবারিরা ইয়াবার ব্যবসা শুরু করে। তখন বিমানবন্দর ব্যবহার করে থাইল্যান্ড হয়ে ইয়াবা আসত। এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপির আমলে বিমানবন্দরে ইয়াবা পাচার কমে আসে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে টেকনাফের শীলবানিয়া পাড়া ও ডেইলপাড়ার পাথর উত্তোলন করে ব্যবসা করতেন তৎকালীন উপজেলা যুবদল নেতা জাকের। বিএনপির শীর্ষ এক নেতার সহায়তায় তিনি এই ব্যবসা করতেন। জাকের টেকনাফ পৌরসভার দক্ষিণ জালিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা। ২০০৮ সালে তাকে ইয়াবাসহ আটকও করা হয়। পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি গা-ঢাকা দেন।

ওই বছর সরকারের নির্দেশে গোয়েন্দা সংস্থা ৯৬ জনের যে তালিকা প্রণয়ন করে, তাতে জাকের ও জাফর আলমকে চিহ্নিত করা হয় শীর্ষ গডফাদার হিসেবে। পরে ২০১৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মাদক কারবারিদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। তাতে তিনি টেকনাফ এলাকার তালিকাভুক্ত কারবারিদের মধ্যে ২০ নম্বরে ছিলেন।

উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাহামুদুল হক চৌধুরী জানান, ১৯৯৩ সালে পাথর ব্যবসা করার সময় জাকেরের সঙ্গে যোগাযোগ করে কারবারিরা। তাকে বোঝানো হয়, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে ঢাকায় পৌঁছে দিলে কোটি টাকার মালিক হওয়া যাবে। জাকের ১৯৯৪ সাল থেকে টেকনাফ দিয়ে ইয়াবা আনার কাজ শুরু করেন। প্রথম দিকে পাথরের ট্রাকে করে ইয়াবা ঢাকায় পাঠানো হতো। ১৯৯৪ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত গোপনে এই মাদক পাচারের কাজ চলে। জাকেরের একার নিয়ন্ত্রণে ছিল পুরো কারবার।

তবে ২০০১ সালে ‘একটেল রমজান’ ইয়াবা ব্যবসার কথা জানতে পারেন। তিনি মূলত মিয়ানমার থেকে সিগারেট এনে টেকনাফের পানের দোকানগুলোতে বিক্রি করতেন।

মিয়ানমারের কিছু লোক মারফত তিনি ইয়াবা পাচারের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। বন্ধ করে দেন সিগারেট আনা। তার সঙ্গে সিন্ডিকেট করে ইয়াবা আনতে শুরু করেন আনোয়ার, ছৈয়দ করিমসহ আরও কয়েকজন।

টেকনাফের একসময়ের পানদোকানি নুরুল আলম জানান, রমজানের বাড়িতে মোবাইল ফোন কোম্পানি একটেলের টাওয়ার বসে। তখন থেকে তার নাম হয় ‘একটেল রমজান’। তিনি একসময় মিয়ানমার থেকে শুধু সিগারেট পাচার করতেন। পরে ইয়াবা পাচার শুরু করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রমজান ১৫ বছর ধরে আত্মগোপনে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি বর্তমানে মিয়ানমারে অবস্থান নিয়ে টেকনাফের এজেন্টদের মাধ্যমে ইয়াবা পাচার করে থাকেন।

বড় হচ্ছে নামের তালিকা

ইয়াবার বিরুদ্ধে কার্যত দৃশ্যমান অভিযান শুরু হয় এক-এগারো পরবর্তী সময়ে। এরপর ২০০৮ সালে সরকারের নির্দেশে গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় প্রথমে একটি ইয়াবা কারবারিদের তালিকা তৈরি করা হয়।

৯৬ জনের এই তালিকায় শীর্ষ গডফাদার হিসেবে জাকের ও জাফর আলমকে চিহ্নিত করা হয়। এরপরও বিভিন্ন দপ্তর থেকে ইয়াবা কারবারিদের তালিকা তৈরি করা হয়। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি একটা তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।

ওই তালিকায় ৭ জন প্রভাবশালীসহ ৭৬৪ জনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। এরপর অনেকবার তালিকা হয়েছে, তাতে নামের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু ইয়াবা কারবার ও পাচার নিয়ন্ত্রণ হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কক্সবাজারে বর্তমানে দুই হাজারের বেশি ব্যক্তি ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত। এ কারবারিদের ৭০ শতাংশ টেকনাফ ও উখিয়ার এবং ৩০ শতাংশ কক্সবাজার সদরের। তাদের মধ্যে কেউ গডফাদার, কেউ পাচারকারী, কেউ আশ্রয়দাতা, কেউ সেবনকারী ও ব্যবসায়ী। সৌজন্যে : প্রতিদিনের বাংলাদেশ

সারাদেশ-এর আরও খবর