বৈরী আবহাওয়ায় উত্তাল সাগর : ভরা মৌসুমেও ইলিশ ধরতে যেতে পারছেন না কক্সবাজারের জেলেরা

  বিশেষ প্রতিনিধি    07-08-2023    73
বৈরী আবহাওয়ায় উত্তাল সাগর : ভরা মৌসুমেও ইলিশ ধরতে যেতে পারছেন না কক্সবাজারের জেলেরা

টানা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ করে গত ২৩ জুলাই থেকে ট্রলার নিয়ে সাগরে নেমেছিলেন কক্সবাজারের জেলেরা। কিন্তু প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে তখন ইলিশের নাগাল পাওয়া যায়নি। জেলেরা বলছেন, বাংলাদেশে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মাছ ধরায় কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল না। ফলে ওইসব দেশের জেলেরা বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানার ভেতর থেকে এই সময়ে মাছ শিকার করেছে। এ কারণে নিষেধাজ্ঞা শেষে এখন আগের মতো ইলিশ ধরা পড়ছে না।

কিন্তু এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বৈরী পরিবেশের কারণে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূল প্রচণ্ড উত্তাল হয়ে রয়েছে।জেলার বিভিন্ন ঘাটে নোঙর করে রাখা হয়েছে শত শত ট্রলার। মাছ ধরতে না পেরে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন জেলার ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি জেলে।

ভরা মৌসুমেও সাগরে মাছ ধরতে না পারায় হতাশ হয়ে পড়েছেন জেলে ও ট্রলারমালিকেরা। গত বছরও এ সময়ে সাগরে বৈরী আবহাওয়া দেখা দিয়েছিল। জেলায় ট্রলার আছে প্রায় ছয় হাজার। রোববার বেলা ১১টায় শহরের বাঁকখালী নদীর ফিশারিঘাট ও ৬ নম্বর ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শ ট্রলার নদীতে নোঙর করে আছে। প্রতি ট্রলারে পাহারার জন্য এক-দুজন করে জেলে শ্রমিক অবস্থান করছেন।

অন্য জেলেরা বাড়ি চলে গেছেন। সকাল থেকে বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। বঙ্গোপসাগরে ঢেউয়ের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে চার-পাঁচ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ছে। জলোচ্ছ্বাসে টেকনাফ-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালার সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এতে উপকূলীয় এলাকায় দুই থেকে চার ফুটের অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে।পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মাছ ধরার নৌযানগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।

কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ায় বাঁকখালী নদী মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। এ নদীর মোহনায় দেশের অন্যতম নৌঘাট ও মৎস্য অবতরণকেন্দ্র। এ ঘাটেই এখন দেড় থেকে দুই হাজার ছোট-বড় মাছ ধরার ট্রলার নোঙর করে আছে। সারি সারি এসব ট্রলারে অলস সময় পার করছেন জেলেরা।

দুপুরে শহরের বাঁকখালী নদীর ৬ নম্বর ঘাটে এফবি সোহেল নামের একটি ট্রলার পাহারা দিচ্ছিলেন জেলে শ্রমিক আমজাদ হোসেন (৪৫)। তাঁর বাড়ি মহেশখালীর কুতুবজোম এলাকায়। ট্রলারে আরও ২২ জন জেলে শ্রমিক থাকেন। এখন আমজাদকে ট্রলারে রেখে অন্য জেলেরা বাড়িতে গেছেন।

আমজাদ হোসেন বলেন, বাড়িতে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে আছেন। দেড় মাস ধরে ঠিকমতো খাবার জোগান দিতে পারছেন না তিনি। সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময়ে নিবন্ধিত জেলেরা চাল পেলেও তিনি কিছুই পাননি। নিষেধাজ্ঞা শেষে ট্রলার নিয়ে সাগরে নেমেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। এখন ট্রলার নামানোর উপায় নেই। এমন পরিস্থিতিতে খালি হাতে বাড়ি যাবেন কী করে?

একই কথা বলেন এফবি কাউসার নামের আরেকটি ট্রলারের জেলে সাব্বির আহমদ। তাঁর বাড়ি চকরিয়ার বদরখালীতে। সাব্বির বলেন, ‘পরিবার জানে, আমি সাগরে মাছ ধরতে গেছি। কিন্তু এখানে ট্রলারের ছোট্ট কুটিরে একাকী পড়ে আছি। দুর্যোগ কেটে গেলে ট্রলার নিয়ে সাগরে নামব। ইলিশ ধরব, তারপর টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরব। তখন যদি সাগরে ইলিশ ধরা না পড়ে কী করব, ভেবে পাচ্ছি না।’

এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের জেলে কামাল উদ্দিন বলেন, জেলেপল্লিতে এখন অভাব–অনটনে দিন পার করছেন লাখো মানুষ। ট্রলার নিয়ে একবার সাগরে নামলে জেলেদের খাওয়াদাওয়া, জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক খাতে খরচ হয় পাঁচ-ছয় লাখ টাকা। সাত-আট মাস ধরে ট্রলারমালিকেরা লোকসান গুনছেন। এ কারণে বিপদে জেলেরা মালিকপক্ষ থেকে তেমন আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছেন না।

মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর কক্সবাজারে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৩৯ হাজার ৩১৪ মেট্রিক টন। এবার ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার মেট্রিক টন।

বছরের এ সময়ে শহরের পাইকারি মাছ বিক্রির প্রধান বাজার ফিশারিঘাট জমজমাট থাকে। এই বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ সরবরাহ করেন ফিশারিঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির অন্তত ৬০০ সদস্য। এখন তাঁরা সবাই বেকার। ফিশারিঘাটে গিয়ে দেখা গেল, পুরো ঘাট ফাঁকা পড়ে রয়েছে।

কক্সবাজারের ইলিশ ব্যবসায়ী ওমর কাজী বলেন, লাখো জেলে বেকার হয়ে বসে আছেন। গত ১৪ দিনে কক্সবাজার থেকে এক মণ ইলিশও ঢাকা, চট্টগ্রামের বাজারে সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।

মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন বলেন, গত বছর নিষেধাজ্ঞা শেষে প্রতিটি ট্রলারের জালে প্রায় ২০ হাজার ইলিশ ধরা পড়েছিল। এবার তার ব্যতিক্রম। নিষেধাজ্ঞা শেষে কয়েক শ ট্রলার সাগরে নামলেও কোনোটিতে ইলিশ ধরা পড়েনি। ইলিশের নাগাল না পেলে লাখো জেলে পরিবারে দুর্দশা নেমে আসবে। পাশাপাশি কোটি কোটি বিনিয়োগ করা ইলিশ ব্যবসায়ী ও ট্রলারমালিকেরা বিপাকে পড়বেন।

কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া পরিস্থিতি কয়েক দিন পর কেটে যেতে পারে। তখন ইলিশ ধরতে সাগরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও চকরিয়া উপজেলার অন্তত ছয় হাজার ট্রলার।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, সাগর শান্ত হলে জেলেরা ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ ধরতে ট্রলার নিয়ে গভীর সাগরে যেতে পারবেন। তখন বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়তে পারে। এতে জেলেদের অভাব দূর হবে।

সারাদেশ-এর আরও খবর