# প্রথম সারির নেতারা বহিষ্কৃত
# আধিপত্য নিয়ে মূল দলেই বিভক্তি
# মেয়াদ উত্তীর্ণ অঙ্গদলে নেই গতি ফেরানোর উদ্যোগ
প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতায় না থাকায় এমনিতেই নাজুক অবস্থা বগুড়া জেলা বিএনপির। এরমধ্যে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ অঙ্গদলে গতি ফেরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে দলীয়ভাবে ডুবতে বসেছে বিএনপির দুর্গখ্যাত বগুড়ার সংগঠনিক কার্যক্রম।
জানা গেছে, প্রথম সারির নেতারা বহিষ্কৃত থাকা এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভক্তির কারণে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ কোন্দল দলে সংকট তৈরি করেছে। ফলে নির্বাচনী বছরে সরকার পতনের আন্দোলনও হচ্ছে অনেকটা রুটিন ওয়ার্কের মতো। কে কার লোক সেই বিভাজন এখন দলের মধ্যে স্পষ্ট। জেলা ছাড়াও উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিরোধের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে দলীয় চেইন অব কমান্ড। ফলে আন্দোলনে দলের বারোটা বাজছে বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে ‘মাঠ কাঁপানো’বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতা এখনো দল থেকে বহিষ্কৃত রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে দায়িত্বে থাকা একটি পক্ষ প্রকাশ্যে না বললেও নিজেদের স্বার্থে তাদের দলে ফেরাতে বিরোধিতা করছেন। এ কারণেই মূল দলে এখন বিভক্তির বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখা দিয়েছে।
মাঠের নেতাকর্মীদের ভাষ্য, বিএনপি একটি বৃহৎ দল। বগুড়ায় তাদের যথেষ্ট জনসমর্থন রয়েছে। এখানে একাধিক আসনে জিয়া পরিবারের সদস্যরা নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকেন। জাতীয় যে কোনো ইস্যু নিয়ে বিএনপির আন্দোলন শুরুর স্থানটিই হচ্ছে এই জেলা। সেখানে দলের ক্ষতি করে নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখার সুযোগ নেই। এরপরেও বিএনপিতে রাহুগ্রাস ছাড়ছে না। আর এসবের প্রভাব পড়েছে অঙ্গসংগঠনেও। জেলা যুবদলসহ এর অধীনে থানা ও পৌর কমিটিগুলো চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। একই অবস্থা ছাত্রদলেও।
২০২২ সালের নভেম্বরে জেলা বিএনপির নির্বাচন ও সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজন নির্বাচিত হন। এরপর প্রায় ১০ মাস পার হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন হয়নি। অন্যদিকে, বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলামপন্থি হিসেবে চিহ্নিত বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মীর বহিষ্কারাদেশ গত চার বছরেও প্রত্যাহার হয়নি। মাঠপর্যায়ে অন্দোলন জমে না ওঠার পেছনে এই বিষয়টিকেও একটা বড় কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরের বছর বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৯ সালে গঠিত নতুন কমিটির আহ্বায়ক করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজকে। একই বছরে বগুড়া সদর সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনে সিরাজকে দলের মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচিত করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা জানান, এই নাটকীয় ঘটনাটি ছিল বগুড়ার রাজনীতিতে বিএনপির বড় ভুল। কারণ, ১/১১ এর সময়ে সংষ্কারপন্থি হিসেবে গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ ছিলেন চিহ্নিত। এ কারণে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা তাকে আহ্বায়ক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। প্রতিবাদে তারা দলের জেলা কার্যালয় দখল করে রাখেন, গেটে তালা ঝুলিয়ে এবং সিরাজের কুশপুতুল দাহ করেন। সেইসঙ্গে শহরে বের করা হয় ঝাড়ু মিছিল। বিএনপির ইমেজ ক্ষুণ্ন করার এই কাজগুলোতে সেসময় যারা জড়িত ছিলেন তারা সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলামের অনুসারী। পরবর্তীতে দলের হাইকমান্ড প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে জেলা বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রভাবশালী অনেক নেতাকে শাস্তি হিসেবে ঢালাওভাবে বহিষ্কার করে। পরে অবশ্য কয়েকজনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
এখনো শাস্তি পাওয়াদের মধ্যে আছেন বগুড়া জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি সিপার আল বখতিয়ার, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পরিমল কুমার দাস, সাবেক প্রকাশনা সম্পাদক শাহ মেহেদী হাসান হিমু, সাবেক তাঁতি বিষয়ক সম্পাদক তৌহিদুল আলম বিটু, সাবেক নির্বাহী সদস্য দেলোয়ার হোসেন পশারী হিরু, যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুকুল ইসলাম, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জুম্মন আলী শেখ, সাবেক সহ-দপ্তর সম্পাদক মমিন আকন্দ, সদস্য বুলবুল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজিব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহাবুল আলম পিপলু, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, শহর কমিটির সাবেক সভাপতি মাহবুব হোসেন লেমন ও সদস্য আবু সাঈদ দুখু, ছাত্রদল বগুড়া জেলা কমিটির সহ-সভাপতি আবু জাফর জেমস ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম আওয়াল।
এদিকে, এই বহিষ্কারের ঘটনাগুলো দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঠে নামা থেকে বিরত রেখেছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। কারণ, যারা বহিষ্কৃত হয়ে রয়েছেন তারা মূলত ফ্রন্ট ফাইটার হিসেবে চিহ্নিত। তাদের রয়েছে বিশাল কর্মী বাহিনী।
একাধিক নেতা জানান, চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই বগুড়া জেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপের ঘটনায় বিএনপির দুই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। গ্রেফতার হন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর তালুকদার হেনা এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি মাজেদুর রহমান জুয়েল।
মাঠের কর্মীরা ধারণা করেছিলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে বগুড়া জেলা বিএনপি একটি বড় রকমের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। মামলার আসামি হয়ে বিএনপি নেতারা রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেয়ে ঢাকায় অবস্থান নেন। তারা নিজেদের রক্ষায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভের দিকেই বেশি মনোযোগী হন। আবার জামিন হয়ে যাওয়ার পরও মাঠের আন্দোলন জমে তুলতে আগ্রহী দেখা যায়নি কাউকে। যে কারণে, গত ১৯ জুলাই গ্রেফতার হওয়া জেলার সাধারণ সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি এখনো জামিন পাননি। তারা বগুড়া জেলা কারাগারে রয়েছেন।
একাধিক নেতাকর্মী জানান, বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও বর্তমানে জেলা বিএনপির মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ স্পষ্ট। এরমধ্যে একটি পক্ষে আছেন জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি ও পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা, সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর হেনা, সাবেক এমপি মোশাররফ হোসেন, শিবগঞ্জ বিএনপির সভাপতি মীর শাহে আলম, শহর বিএনপির সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী হিরু, সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাফতুন আহমেদ খান রুবেল।
অপর পক্ষে আছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান, আরেক সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম, সাবেক এমপি হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, শেরপুর উপজেলার সাবেক সভাপতি জানে আলম খোকা, জেলার সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এম আর ইসলাম স্বাধীন।
তবে বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, বিরোধের কোনো বিষয় নেই। আমরা শহীদ জিয়ার সৈনিক। তারেক রহমানের নির্দেশনা মেনে রাজনীতি করি। তিনি বগুড়ার সব ব্যাপার জানেন। তার সিদ্ধান্তই এখানে সবকিছু।
বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে দল সাজানোর কাজ করছি। বিএনপি এখন আগের চেয়ে অনেক সুশৃঙ্খল ও উজ্জীবিত। দলের মধ্যে বিভাজনের অভিযোগ সঠিক নয়। অনেকে শত্রুতা করে নেগেটিভ কথা বলে।
যুবদলের সাবেক সভাপতি ও পৌর কাউন্সিলর সিপার আল বখতিয়ার বলেন, মানুষ ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। আমরা তারেক রহমানসহ সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমার সঙ্গী অনেকেই এখনো রাজনৈতিক মামলার আসামি হয়ে আদালতে হাজিরা দিচ্ছে। বিগত সময়ে বগুড়ার তুমুল আন্দোলনে আমরা সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি। এখন আবারও রাজপথে থেকে কঠোর আন্দোলন করতে চাই। আমাদের এ সুযোগ দেওয়া হোক।
উপজেলাতেও দ্বন্দ্ব
২০২২ সালে জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ধুনট উপজেলা কমিটি গঠন ছাড়াই। কারণ, সে সময় ধুনট উপজেলা ও পৌর কমিটির সম্মেলন করা ছিল না। কিন্তু অতিসম্প্রতি জেলা বিএনপির নেতারা মামলাজনিত কারণে ঢাকায় অবস্থানকালেই হঠাৎ করেই এই উপজেলায় নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এক চিঠিতে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল আলম মামুনকে সভাপতি ও আবুল মুনসুর আহম্মেদকে সম্পাদক করে ছয় সদস্যের কমিটি করা হয়। কারাগারে থাকা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর তালুকদার হেনার সই ছাড়াই এই কমিটি কীভাবে ঘোষণা হলো তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। কমিটির ঘোষণাপত্রে শুধু জেলা বিএনপির সভাপতির সই ছিল।
এছাড়া জেলা সম্মেলনের আগে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা বিএনপির সম্মেলন ও নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেনে অভিযোগ ওঠে। সেখানে টাকার কারণেই এনামুল হক শাহীনকে সভাপতি করা হয় বলে বিএনপির কর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শাজাহানপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আলী হায়দার তোতা বলেন, বিভিন্ন সময়ে শাজাহানপুর উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ৯০টি ওয়ার্ড কমিটি গঠনকালে দলের ত্যাগী, হামলা-মামলার শিকার নেতাদের বাদ দিয়ে অর্থ বাণিজ্যের মাধ্যমে কমিটিতে পদ বিক্রি করা হয়েছে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, উপজেলার বর্তমান সভাপতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশির দশকের ছাত্রমৈত্রী নেতা এনামুল হক শাহীন ছিলেন সাবেক যুবদল নেতা। তিনি কখনো বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতা ছিলেন না। তারপরেও ত্যাগী বিএনপি নেতাদের বাদ দিয়ে সেই সাবেক যুবদল নেতাকে উপজেলা বিএনপির সভাপতি করা হয়। এই উপজেলার সাধারণ নেতাকর্মীরা এখনো বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি।
কোন্দলে ডুবছে বগুড়া বিএনপি
# প্রথম সারির নেতারা বহিষ্কৃত
# আধিপত্য নিয়ে মূল দলেই বিভক্তি
# মেয়াদ উত্তীর্ণ অঙ্গদলে নেই গতি ফেরানোর উদ্যোগ
প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতায় না থাকায় এমনিতেই নাজুক অবস্থা বগুড়া জেলা বিএনপির। এরমধ্যে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ অঙ্গদলে গতি ফেরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে দলীয়ভাবে ডুবতে বসেছে বিএনপির দুর্গখ্যাত বগুড়ার সংগঠনিক কার্যক্রম।
জানা গেছে, প্রথম সারির নেতারা বহিষ্কৃত থাকা এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভক্তির কারণে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ কোন্দল দলে সংকট তৈরি করেছে। ফলে নির্বাচনী বছরে সরকার পতনের আন্দোলনও হচ্ছে অনেকটা রুটিন ওয়ার্কের মতো। কে কার লোক সেই বিভাজন এখন দলের মধ্যে স্পষ্ট। জেলা ছাড়াও উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিরোধের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে দলীয় চেইন অব কমান্ড। ফলে আন্দোলনে দলের বারোটা বাজছে বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে ‘মাঠ কাঁপানো’বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতা এখনো দল থেকে বহিষ্কৃত রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে দায়িত্বে থাকা একটি পক্ষ প্রকাশ্যে না বললেও নিজেদের স্বার্থে তাদের দলে ফেরাতে বিরোধিতা করছেন। এ কারণেই মূল দলে এখন বিভক্তির বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখা দিয়েছে।
মাঠের নেতাকর্মীদের ভাষ্য, বিএনপি একটি বৃহৎ দল। বগুড়ায় তাদের যথেষ্ট জনসমর্থন রয়েছে। এখানে একাধিক আসনে জিয়া পরিবারের সদস্যরা নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকেন। জাতীয় যে কোনো ইস্যু নিয়ে বিএনপির আন্দোলন শুরুর স্থানটিই হচ্ছে এই জেলা। সেখানে দলের ক্ষতি করে নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখার সুযোগ নেই। এরপরেও বিএনপিতে রাহুগ্রাস ছাড়ছে না। আর এসবের প্রভাব পড়েছে অঙ্গসংগঠনেও। জেলা যুবদলসহ এর অধীনে থানা ও পৌর কমিটিগুলো চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। একই অবস্থা ছাত্রদলেও।
২০২২ সালের নভেম্বরে জেলা বিএনপির নির্বাচন ও সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজন নির্বাচিত হন। এরপর প্রায় ১০ মাস পার হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন হয়নি। অন্যদিকে, বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলামপন্থি হিসেবে চিহ্নিত বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মীর বহিষ্কারাদেশ গত চার বছরেও প্রত্যাহার হয়নি। মাঠপর্যায়ে অন্দোলন জমে না ওঠার পেছনে এই বিষয়টিকেও একটা বড় কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরের বছর বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৯ সালে গঠিত নতুন কমিটির আহ্বায়ক করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজকে। একই বছরে বগুড়া সদর সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনে সিরাজকে দলের মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচিত করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা জানান, এই নাটকীয় ঘটনাটি ছিল বগুড়ার রাজনীতিতে বিএনপির বড় ভুল। কারণ, ১/১১ এর সময়ে সংষ্কারপন্থি হিসেবে গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ ছিলেন চিহ্নিত। এ কারণে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা তাকে আহ্বায়ক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। প্রতিবাদে তারা দলের জেলা কার্যালয় দখল করে রাখেন, গেটে তালা ঝুলিয়ে এবং সিরাজের কুশপুতুল দাহ করেন। সেইসঙ্গে শহরে বের করা হয় ঝাড়ু মিছিল। বিএনপির ইমেজ ক্ষুণ্ন করার এই কাজগুলোতে সেসময় যারা জড়িত ছিলেন তারা সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলামের অনুসারী। পরবর্তীতে দলের হাইকমান্ড প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে জেলা বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রভাবশালী অনেক নেতাকে শাস্তি হিসেবে ঢালাওভাবে বহিষ্কার করে। পরে অবশ্য কয়েকজনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
এখনো শাস্তি পাওয়াদের মধ্যে আছেন বগুড়া জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি সিপার আল বখতিয়ার, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পরিমল কুমার দাস, সাবেক প্রকাশনা সম্পাদক শাহ মেহেদী হাসান হিমু, সাবেক তাঁতি বিষয়ক সম্পাদক তৌহিদুল আলম বিটু, সাবেক নির্বাহী সদস্য দেলোয়ার হোসেন পশারী হিরু, যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুকুল ইসলাম, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জুম্মন আলী শেখ, সাবেক সহ-দপ্তর সম্পাদক মমিন আকন্দ, সদস্য বুলবুল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজিব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহাবুল আলম পিপলু, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, শহর কমিটির সাবেক সভাপতি মাহবুব হোসেন লেমন ও সদস্য আবু সাঈদ দুখু, ছাত্রদল বগুড়া জেলা কমিটির সহ-সভাপতি আবু জাফর জেমস ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম আওয়াল।
এদিকে, এই বহিষ্কারের ঘটনাগুলো দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঠে নামা থেকে বিরত রেখেছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। কারণ, যারা বহিষ্কৃত হয়ে রয়েছেন তারা মূলত ফ্রন্ট ফাইটার হিসেবে চিহ্নিত। তাদের রয়েছে বিশাল কর্মী বাহিনী।
একাধিক নেতা জানান, চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই বগুড়া জেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপের ঘটনায় বিএনপির দুই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। গ্রেফতার হন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর তালুকদার হেনা এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি মাজেদুর রহমান জুয়েল।
মাঠের কর্মীরা ধারণা করেছিলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে বগুড়া জেলা বিএনপি একটি বড় রকমের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। মামলার আসামি হয়ে বিএনপি নেতারা রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেয়ে ঢাকায় অবস্থান নেন। তারা নিজেদের রক্ষায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভের দিকেই বেশি মনোযোগী হন। আবার জামিন হয়ে যাওয়ার পরও মাঠের আন্দোলন জমে তুলতে আগ্রহী দেখা যায়নি কাউকে। যে কারণে, গত ১৯ জুলাই গ্রেফতার হওয়া জেলার সাধারণ সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি এখনো জামিন পাননি। তারা বগুড়া জেলা কারাগারে রয়েছেন।
একাধিক নেতাকর্মী জানান, বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও বর্তমানে জেলা বিএনপির মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ স্পষ্ট। এরমধ্যে একটি পক্ষে আছেন জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি ও পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা, সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর হেনা, সাবেক এমপি মোশাররফ হোসেন, শিবগঞ্জ বিএনপির সভাপতি মীর শাহে আলম, শহর বিএনপির সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী হিরু, সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাফতুন আহমেদ খান রুবেল।
অপর পক্ষে আছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান, আরেক সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম, সাবেক এমপি হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, শেরপুর উপজেলার সাবেক সভাপতি জানে আলম খোকা, জেলার সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এম আর ইসলাম স্বাধীন।
তবে বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, বিরোধের কোনো বিষয় নেই। আমরা শহীদ জিয়ার সৈনিক। তারেক রহমানের নির্দেশনা মেনে রাজনীতি করি। তিনি বগুড়ার সব ব্যাপার জানেন। তার সিদ্ধান্তই এখানে সবকিছু।
বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে দল সাজানোর কাজ করছি। বিএনপি এখন আগের চেয়ে অনেক সুশৃঙ্খল ও উজ্জীবিত। দলের মধ্যে বিভাজনের অভিযোগ সঠিক নয়। অনেকে শত্রুতা করে নেগেটিভ কথা বলে।
যুবদলের সাবেক সভাপতি ও পৌর কাউন্সিলর সিপার আল বখতিয়ার বলেন, মানুষ ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। আমরা তারেক রহমানসহ সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমার সঙ্গী অনেকেই এখনো রাজনৈতিক মামলার আসামি হয়ে আদালতে হাজিরা দিচ্ছে। বিগত সময়ে বগুড়ার তুমুল আন্দোলনে আমরা সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি। এখন আবারও রাজপথে থেকে কঠোর আন্দোলন করতে চাই। আমাদের এ সুযোগ দেওয়া হোক।
উপজেলাতেও দ্বন্দ্ব
২০২২ সালে জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ধুনট উপজেলা কমিটি গঠন ছাড়াই। কারণ, সে সময় ধুনট উপজেলা ও পৌর কমিটির সম্মেলন করা ছিল না। কিন্তু অতিসম্প্রতি জেলা বিএনপির নেতারা মামলাজনিত কারণে ঢাকায় অবস্থানকালেই হঠাৎ করেই এই উপজেলায় নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এক চিঠিতে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল আলম মামুনকে সভাপতি ও আবুল মুনসুর আহম্মেদকে সম্পাদক করে ছয় সদস্যের কমিটি করা হয়। কারাগারে থাকা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর তালুকদার হেনার সই ছাড়াই এই কমিটি কীভাবে ঘোষণা হলো তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। কমিটির ঘোষণাপত্রে শুধু জেলা বিএনপির সভাপতির সই ছিল।
এছাড়া জেলা সম্মেলনের আগে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা বিএনপির সম্মেলন ও নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেনে অভিযোগ ওঠে। সেখানে টাকার কারণেই এনামুল হক শাহীনকে সভাপতি করা হয় বলে বিএনপির কর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শাজাহানপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আলী হায়দার তোতা বলেন, বিভিন্ন সময়ে শাজাহানপুর উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ৯০টি ওয়ার্ড কমিটি গঠনকালে দলের ত্যাগী, হামলা-মামলার শিকার নেতাদের বাদ দিয়ে অর্থ বাণিজ্যের মাধ্যমে কমিটিতে পদ বিক্রি করা হয়েছে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, উপজেলার বর্তমান সভাপতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশির দশকের ছাত্রমৈত্রী নেতা এনামুল হক শাহীন ছিলেন সাবেক যুবদল নেতা। তিনি কখনো বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতা ছিলেন না। তারপরেও ত্যাগী বিএনপি নেতাদের বাদ দিয়ে সেই সাবেক যুবদল নেতাকে উপজেলা বিএনপির সভাপতি করা হয়। এই উপজেলার সাধারণ নেতাকর্মীরা এখনো বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি।
সম্পাদক ও প্রকাশক
শেখ জাহিদ হোসেন
নির্বাহী সম্পাদক
আলহাজ্ব শেখ সিদ্দিকুর রহমান
বার্তা সম্পাদক
তাকছিমুন নাহার
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
ইঞ্জিনিয়ার কে এম মেহেদী হাসান |
মোবাইল: ০১৭১১২৪৯৭৭০
হোয়াটস্অ্যাপ: ০১৭১১২৪৯৭৭০
প্রধান কার্যালয় মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
|
প্রিন্টের তারিখ ও সময়: October 9, 2024, 3:44 pm