কক্সবাজার থেকে ইলিশ রপ্তানীর চাপে স্থানীয় বাজারে ঘাটতি : চড়া দামে ক্রেতাদের ক্ষোভ

  বিশেষ প্রতিনিধি    20-08-2023    170
কক্সবাজার থেকে ইলিশ রপ্তানীর চাপে স্থানীয় বাজারে ঘাটতি : চড়া দামে ক্রেতাদের ক্ষোভ

বঙ্গোপসাগরে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর দেশের সর্বাধিক ইলিশ আহরণ জেলা কক্সবাজার থেকে দিন দিন বেড়েই চলেছে ইলিশের সরবরাহ। জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে গত সাত দিনে কক্সবাজার থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ২ হাজার ১০০ মেট্রিক টনের বেশি ইলিশ সরবরাহ করা হয়েছে।

তবে স্থানীয় ক্রেতারা বলছেন, কক্সবাজারে শত শত টন ইলিশ আসলেও রপ্তানীর চাপে এই প্রিয় মাছটি আগের চেয়ে বেশ চড়া দামে কিনতে হচ্ছে।

কক্সবাজারের শহর ও গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারগুলোতে ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া। বিক্রেতারা বলছেন, চাহিদার তুলনায় বাজারে মাছের সরবরাহ বেশি কিন্তু দাম কমছে না। অথচ বছরের এই সময় ইলিশের দাম কিছুটা পড়তির দিকে থাকে।মূলত ঢাকা ও পশ্চিমবঙ্গের বড় বড় মাছ ব্যবসায়ীদের চাহিদার কারণে লোকাল মাকেটে ইলিশ মাছের সরবরাহ কম।

স্থানীয়দের অভিযোগ,ঢাকাসহ ভারতে বিপুল পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে বিধায়, বাজারে চাহিদা অনুযায়ী জোগান মিলছে না। যে কারণে বেশি দাম গুণতে হচ্ছে ইলিশ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত কক্সবাজার জেলার মানুষকে। এবছর অনেকেই এত দামের ইলিশ মাছ ছুঁয়েও দেখতে পারছেন না।

স্থানীয় ক্রেতারা মনে করছেন, জেলার বড় বড় আড়তদাররা স্থানীয়দের চাহিদার চেয়ে ঢাকার ব্যবসায়ীদের রপ্তানীকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। ইলিশের বাজারেও তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

জেলার প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও পাইকারি বাজার শহরের বাঁকখালী নদীর ফিশারি ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশ কিনতে ঘাটে ছিল ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু, সাধারণ ক্রেতারা ইলিশের দাম দেখে খালি হাতে চলে যাচ্ছেন।

ফিশারি ঘাটের ইলিশ ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘গত বছর এ সময় যে ইলিশের দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ছিল। এবার এসব ইলিশের দাম প্রায় দিগুণ ১১০০ থেকে ১৫০০ টাকা। যার কারণ মাছের চাহিদার তুলনায় ক্রেতা কম।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এ সময় ইলিশের দামের এত ফারাকের কারণ হচ্ছে, বিপুল পরিমাণ মাছ ঢাকা এবং ভারতে চলে যাচ্ছে।

ঘাটে মাছ কিনতে আসা জুনাইদ কক্সবাংলাকে জানান, ‘নিষেধাজ্ঞা ও বৈরী আবাহওয়ার পর বেশ ভালোই মাছ পাওয়া যাচ্ছে বলে কিনতে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে ইলিশে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। এক কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশের দাম চায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ১৭০০ হাজার টাকা, ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম নিচ্ছে এক হাজারন থেকে ১১০০ টাকা, একটু ছোট ইলিশের দাম চায় কেজিপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। কীভাবে ইলিশ কিনব?’

রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহরের ফিশারিঘাটের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে এক ট্রলারে জেলেদের জালে এক টানেই ৫২ লাখ টাকার ইলিশ ধরা পড়েছে।

কক্সবাজারের পেশকারপাড়া এলাকার আবদুস সাত্তারের মালিকানাধীন একটি ট্রলারে মাছগুলো ধরা পড়ে।

ট্রলারের জেলে আবদুল গণী বলেন, ছয় দিন আগে একটি ট্রলার নিয়ে তাঁরা ২১ জন জেলে সাগরে নামেন।

উপকূল থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে জাল ফেললে একসঙ্গে ৭ হাজার ৩০০টি ইলিশ ধরা পড়ে। মাছগুলো ফিশারিঘাটে এনে বিক্রি করে ৫২ লাখ টাকা পেয়েছেন।

আজ রাতে তাঁরা আবার ইলিশ আহরণে সাগরে যাবেন বলে তিনি জানান।

জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য বলছে, গত সাত দিনে কক্সবাজার জেলা থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ২ হাজার ১০০ মেট্রিক টনের বেশি ইলিশ সরবরাহ করা হয়েছে। ফিশারিঘাটের পাইকারি বাজার ছাড়াও টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়াসহ জেলার বিভিন্ন মৎস্যকেন্দ্র থেকে দৈনিক ৩০০ মেট্রিক টন ইলিশ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হচ্ছে।

এর আগে গত বছর কক্সবাজারে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৩৯ হাজার ৩১৪ মেট্রিক টন। এবার ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার মেট্রিক টন।

রোববার ফিশারিঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, বেচাবিক্রির জন্য তোলা অধিকাংশ ইলিশের ওজন ৮০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি। বেচাবিক্রিও হচ্ছে চড়া দামে। বাজারে ৯০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের প্রতিটি ইলিশ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ টাকায়, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা, ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ৫৫০-৬০০ টাকায়।

শহরের নুনিয়াছটার আবদুল শুক্কুরের মালিকানাধীন আরেকটি ট্রলার ৭ হাজার ইলিশ বিক্রি করেন ৪৮ লাখ টাকায়। দুপুরে ফিশারিঘাটে দেড় হাজার ইলিশ বিক্রি করে সাড়ে ১২ লাখ টাকা পেয়েছে শহরের ৬ নম্বর ঘাট এলাকার নাসির উদ্দিনের মালিকানাধীন একটি ট্রলার।

নাসির উদ্দিন বলেন, কম-বেশি সব ট্রলারে ৫০০ থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত ইলিশ ধরা পড়ছে। মাছ ধরা পড়ায় খুশি জেলে শ্রমিক ও ট্রলারের মালিকেরা।

ফিশারিঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির উপদেষ্টা ও ইলিশ ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন বলেন, ফিশারিঘাট থেকে সকাল ৮টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ২০ মেট্রিক টনের মতো ইলিশ ঢাকা-চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়েছে। ইলিশের দাম আগের তুলনায় কিছুটা কমতে শুরু করেছে। বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকার বাজারে ইলিশের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় কক্সবাজারের ইলিশের চাহিদা কমছে। এ কারণে দামও কমতে শুরু করেছে।

ইলিশ ব্যবসায়ীরা বলছেন, কক্সবাজার থেকে ট্রাকে প্রতি কেজি ইলিশ ঢাকায় পাঠাতে পরিবহন ও প্যাকেজিং খরচ যাচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এ কারণে ঢাকায় প্রতি কেজি ইলিশের বিপরীতে ১০ থেকে ২০ টাকার বেশি লাভ করা যাচ্ছে না।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, ফিশারিঘাটে পাইকারি ইলিশ বিক্রির বাজারসহ টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলে দৈনিক ৫০০ মেট্রিক টন সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩০০ মেট্রিক টন ইলিশ। আহরিত ইলিশের মধ্যে ৬০ ভাগের ওজন ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি। ৩০ শতাংশের ওজন ১ থেকে দেড় কেজি। বাকিগুলো দেড় থেকে দুই কেজির।

কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, ইলিশ ধরতে সাগরে অবস্থান করছে জেলার ছয় হাজার ট্রলার। ট্রলারগুলো ঘাটে ফিরলে ইলিশে সয়লাব হয়ে যাবে হাটবাজার।

সারাদেশ-এর আরও খবর