সিলেটের মৌলভীবাজারের ছাতকছড়ায় একটি মেয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। সেই ‘অপরাধে’ তাকে শাস্তি দিয়ে ফতোয়া দিলেন গ্রামের মসজিদের ইমাম।
মেয়েটিকে বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর ছোড়া হলো। পাথর তার মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত করে দিল, কিন্তু তার থেকে বেশি ক্ষতবিক্ষত করল তার আত্মসম্মানবোধকে, মানুষ হিসেবে তার পরিচিতিকে এবং সমাজ, মানুষ ও ধর্মের ওপর তার বিশ্বাসকে। এক বিশাল অবিশ্বাস এবং অপমানের ভার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করল।
আমাদের সকলের মতো ইমদাদুল হক মিলনের মনেও ঘটনাটি গভীর দাগ কাটল। মেয়েটির জন্য তাঁর গভীর মমতা হলো; যে ইমামের ফতোয়া মেয়েটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল, তার প্রতি তাঁর ঘৃণা জাগল। কিন্তু মেয়েটিকে তাঁর সহানুভূতি, তাঁর ভালোবাসা যে জানাবেন, তার কোনো উপায় নেই। মসজিদের ওই ইমামকে তিনি হয়তো তাঁর ঘৃণার কথা জানাতে পারতেন, কিন্তু তাতে তার কোনো বিকার হতো, তার বিবেক আর অপরাধবোধ জাগত—তেমন সম্ভাবনা ছিল না। মিলন সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি একটি উপন্যাসে মেয়েটিকে আঁকবেন, পাঠকের মনে চিরকালের জন্য একটা জায়গা তাকে করে দেবেন। আর নিষ্ঠুর ইমামকে তিনি পাঠকের আদালতে হাজির করবেন দিনের পর দিন, তারা তাকে শাস্তি দেবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ যা, আমাদের চারদিকে প্রচুর বিপন্নতা নিয়ে বেঁচে থাকা বাস্তব জীবনের এ রকম মেয়েগুলোকে পাঠকরা সুরক্ষা দেবে, বাস্তবের বিবেকহীন হন্তারকগুলোকে তারা প্রতিরোধ করবে। একটি উপন্যাসের অনেক শক্তি, অনেক দূর সে যেতে পারে। পাঠককে জাগাতে পারে। তাকে শুদ্ধ করতে পারে।
মিলন তাঁর লেখার শক্তিতে বিশ্বাসী, সে জন্য তাঁর লেখা পাঠককে স্পর্শ করে। যেমন তাঁর ‘পরাধীনতা’ আমাকে স্পর্শ করেছিল, এবং আমি স্পর্শিত হওয়ার কথাটা লিখে বর্ণনা করেছিলাম। তাঁর ‘নূরজাহান’ও আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। অনেক দিন পর এ বইটি নিয়ে লিখছি, যদিও মিলনের অনেক উপন্যাস আমি পড়েছি, নানা মাত্রায় সেগুলোর অভিঘাত আমি উপলব্ধি করেছি; কিন্তু ‘নূরজাহান’ এগুলোর চেয়ে কিছুটা ভিন্ন, যার প্রধান কারণ এর এপিক বিস্তার। তবে উপন্যাসটির প্রায় ১১০০ পৃষ্ঠার কলেবর এই বিস্তার তৈরি করেনি, করেছে মিলনের কল্পনার বিশালতা—এক সামান্য গ্রামের অসামান্য এক জীবনচিত্রকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সচল রাখার তাঁর ক্ষমতা; এক বিশাল ক্যানভাসে অসংখ্য চরিত্রকে তাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত আর সামষ্টিক জীবন নিয়ে হাজির করা, ছোট ছোট ঘটনা দিয়ে ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তের দিকে গল্পরেখাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আর মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি আর ঋতুবদলের ভেতরের রসায়নগুলোকে সম্পৃক্ত করার তাঁর দক্ষতা। মিলন সংবেদী লেখক, তিনি একটা কোমল হাত রাখেন তাঁর অকিঞ্চিৎকর সব চরিত্রের পিঠে, তাদের আনন্দে হাসেন, তাদের দুঃখে কাঁদেন। কিন্তু তাঁর বর্ণনায় এর প্রকাশ্য ছায়াপাত ঘটাতে দেন না। তিনি অনেক ঘটনায় নিজেকেও বিনিয়োগ করেন, তাঁর পক্ষপাতিত্ব আমরা টের পাই, তাঁর ক্রোধ অথবা পুলক আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু সেগুলো গল্পের একটা গভীরেই শুধু সক্রিয় হয়। গল্প বলায় তিনি একটা বস্তুনিষ্ঠতা মেনে চলেন। ফলে পাঠক একটি ঘটনার অনিবার্যতাকে যেমন বাস্তবের কার্যকারণ সূত্রে ফেলে মাপতে পারেন, তেমনি এর পেছনে লেখকের পক্ষগ্রহণের বিষয়টিও অনুধাবন করেন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে, উদাহরণটি ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের শেষ দিক থেকে নেওয়া (শুরুর থেকে উদাহরণ দিলে হয়তো যথাযথ হতো, কিন্তু শেষ দিকের উদাহরণটি এমনই প্রাসঙ্গিক আমার ওপরের বক্তব্যের সঙ্গে যে তা দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না)।
নূরজাহানকে ফতোয়া দিয়ে দুজন শাগরেদ লাগিয়ে তাকে একটা গর্তে পুরে মসজিদ বানানোর খোয়া-সুরকি ছুড়ে মাওলানা মান্নান তার প্রতিহিংসা মেটাল। নূরজাহানের মুখ ও মাথা রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হলো, সে একসময় টলতে টলতে উঠে বাড়ি গিয়ে অ্যানড্রিন খেল, এবং তার মারা যাওয়ার পর মেদিনীমণ্ডলের দৃশ্যপট বদলে গেল। পুলিশ এলো এবং মাওলানা মান্নানকে ধরে নিয়ে গেল কোমরে দড়ি দিয়ে, যে রকম দড়ি দিয়ে নিষ্পাপ মাকুন্দা কাশেমকে সে চোর সাজিয়ে গ্রাম থেকে বিদেয় করে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের এক কর্তা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, এবার রাজাকার মাওলানাকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পিছু পিছু তাড়া করে আসা বাদলা নাদের হামেদ আলালদ্দি বারেকের মতো কিশোর তরুণরা পাষণ্ড মাওলানাকে যখন ঢিল ছুড়ে মারছে, সে কিছুই বলল না। মাওলানার মুখে-মাথায় ঢিল পড়তে দিল। মিলন এরপর লেখেন, “আর কথা নাই। হালটের পাশ থেকে তুমুল ক্রোধে বৃষ্টির মতন চাকা পড়তে লাগলো মান্নান মাওলানার মুখে। হাত তুইলা, মুখ নিচা কইরা, চিৎকার চেঁচামেচি কইরা নানানভাবে পোলাপানের চাকার হাত থেকে নিজেরে রক্ষা করতে চাইলো, পারলো না। ” এই বর্ণনা কি কোনো চরিত্র দিচ্ছে? না, দিচ্ছেন লেখক। কিন্তু তিনিই তো এর অনেক আগে মান্নান মাওলানা আর তার ছেলে আতাহারের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার মাকুন্দা কাশেমের ভয়ার্ত আর্তনাদ এবং সেই আর্তনাদে তার শেষ হতে যাওয়া আয়ু কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখার নিষ্ফল চেষ্টার পর লিখেছিলেন, “মাকুন্দা কাশেমের বুকফাটা আর্তনাদে তখন স্তব্ধ হয়েছিল জেগে ওঠা মানুষ, ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছিল শীতরাত্রির নিস্তব্ধতা। ” এই ভাষিক পরিবর্তন কেন? কিশোর-তরুণদের হাতে মান্নান মাওলানার শাস্তি পাবার দৃশ্যে কেন তিনি চলে গেলেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের ভাষায়, ক্ষণিক ছুটি নিলেন সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীর অবস্থান থেকে, হয়ে গেলেন বাদলা নাদের হামেদদের একজন?
উদাহরণটি আমি দিয়েছি লেখকের পক্ষগ্রহণের প্রসঙ্গে। রাজনীতিতে যেমন শেষ বিচারে নিরপেক্ষতা বলে কেউ নেই—যিনি একটি নির্বাচনে ভোট দিতে যান না, তিনিও একটি পক্ষ নেন, হয়তো নির্বাচনের অসারতার বিপক্ষেই—লেখালেখিতেও নিরপেক্ষতা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র। যাঁরা সমাজ নিয়ে লেখেন, সমাজের অসংগতি-অবিচার আর স্খলন-পতন নিয়ে লেখেন, তাঁরা ক্ষমতার আর বিত্তের বিপরীতে থাকা মানুষগুলোরই পক্ষ নেন। এই পক্ষগ্রহণ বেশির ভাগই প্রচ্ছন্ন; প্রায়ই তার আয়োজন থাকে না, উত্তেজনাও থাকে না। মিলনও অনেক উপন্যাসে এই পক্ষপাত প্রচ্ছন্নই রাখেন, কিন্তু ‘পরাধীনতা’ ও ‘নূরজাহান’-এ এটি অনেকটাই স্পষ্ট। ‘পরাধীনতা’য় দুই পক্ষ ছিল, অথবা দুটি পক্ষের অনেক রূপ ছিল—দেশ-বিদেশ, মুক্তি-অন্তরিনতা, বস্তুর নিগড়-কল্পনার উড়াল, যন্ত্র-মানুষ। ‘নূরজাহান’-এ মিলন নিজে আছেন, এবং তাঁর যে সত্তার আড়ালে বর্ণনাকারী তার গল্প বুনে যায়, নিঃশব্দে জাল বুনে যাওয়া কোনো মাকড়সার মতো, সে নিজেই তো রক্তাক্ত। রূঢ় বাস্তব, বাস্তবের কল্পনা আর কল্পনার বাস্তব এমন অনিবার্যভাবে মিলে যায় এই উপন্যাসে যে, কোনো ঘটনাকেই আর কল্পিত মনে হয় না।
‘নূরজাহান’-এর গল্প জীবন পায় মিলনের চেনা অন্তরঙ্গ ভূগোলে, তাঁর নিজের উঠানে। এই উঠানে তাঁর অধিকার ষোলো আনা। এর চরিত্ররা তাঁর চেনা, এর গাছপালা বিছিয়ে থাকে তার করতলে। এই উঠানে যখন কোনো অপচ্ছায়া পড়ে, একটি দুরন্ত কিশোরীকে বেঁধে ফেলে তার অপরিষ্কার শেকলে, তখন তিনিও জেগে ওঠেন। ‘নূরজাহান’ এ জন্য এত টানে আমাদের। আধুনিক সাহিত্যের তাত্ত্বিকরা বলবেন, ওই পক্ষগ্রহণ গল্পের জন্য ক্ষতিকর; উত্তরাধুনিক তত্ত্বের প্রবক্তারা বলবেন, এতে কোনো দোষ নেই—বস্তুত গল্পকে তা মানবিক করে। মিলন উত্তরাধুনিক লেখক নন, কিন্তু তিনি গল্প বলার ঐতিহ্যকে ধারণ করেন। সেই ঐতিহ্যে পক্ষগ্রহণ একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে বিষয়টা আরো গভীর—এবং তা হচ্ছে, পক্ষগ্রহণে গল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় কি না!
মিলন দেখান, ক্ষতি নয়, তাতে লাভ হয়। একটা বিশাল ক্যানভাসের কাজ একটা জায়গা খুঁজে পায়। নূরজাহানের পুনর্জন্ম হয়, পাঠকের চেতনায়। পৃথিবীর সব মান্নান মাওলানা একজোট হয়েও তাকে আর মারতে পারে না।
‘নূরজাহান’-এর শেষ অংশটি আমার বিস্ময় জাগিয়েছে। মিলন যেভাবে ঋতু ধরে ধরে অগ্রসর হয়ে মেদিনীমণ্ডল গ্রামটির একটি চালচিত্র মেলে ধরেছেন, তাতে মান্নান মাওলানার চরিত্রটি অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছে। মাকুন্দা কাশেমকে পিটিয়ে মৃতপ্রায় করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার পর তার অবস্থান আরো পোক্ত হয়েছে। এই উপন্যাসের খল চরিত্রগুলো প্রায় সবাই একটা অপ্রতিরোধ্য অবস্থানে চলে যায়। আতাহার, সড়কের কন্ট্রাক্টর আলী আমজাদ এবং আতাহারের সাঙ্গোপাঙ্গকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে তেমন মনে হয় না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তাদের পরাজিত হওয়া তো দূরের কথা, তাদের কেউ বিপদে ফেলতে পারে, সে রকম ভাবারও কথা নয়। কিন্তু সবাই তারা হেরে যায়। মান্নান মাওলানার মুখে যেদিন নূরজাহান থুতু ছিটিয়ে দিল, সেদিন থেকেই তার সেই পরাজয়। ধূর্ত ও নিষ্ঠুর এই মাওলানা এরপর প্রতিশোধ নিতে নামল। তার পরিকল্পনা ধরে সে এগোল। দেলোয়ারার ভালোমানুষি এবং এনামুলের বদান্যতায় সে একটি মসজিদের ইমাম হলো। এর আগে সে নূরজাহানকে স্ত্রী হিসেবে অধিকারের চেষ্টা করে বিফল হলেও প্রতিশোধটা সে ঠিকই নিল। তার বিরুদ্ধে একটা ফতোয়া দিয়ে নিজেই বসল বিচারে। এইখানে এসে মিলনের জন্য দুটি পথ খোলা ছিল—তিনি বাস্তবকে মেনে নিয়ে মান্নান মাওলানাকে তার বিজয়মুহূর্তে ছেড়ে দিতে পারতেন, এবং নূরজাহানকে এক হতভাগ্য ও ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবে তার করুণ পরিণতির কাছে সমর্পণ করতে পারতেন, যা পাঠককে একসময় একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বলতে বাধ্য করত, “এ আর এমন কী, বাংলাদেশের নূরজাহানদের কপালে এই তো লেখা থাকে, আর বাংলাদেশের মান্নান মাওলানাদের এমনই তরক্কি হয়”; অথবা মান্নান মাওলানার পরাজয়টা দেখাতে পারতেন। তিনি দ্বিতীয় পথটা শুধু বেছে নেননি, এই পরাজয়কে একটা প্রতীকী মাত্রায় বাংলাদেশের জেগে ওঠা হিসেবেও দেখিয়েছেন। মাকুন্দা কাশেমের মৃত্যুর সময় জেগে ওঠা মানুষ স্তব্ধ হয়ে ছিল, মান্নান মাওলানার শাস্তি নিশ্চিত করার সময় জেগে থাকা মানুষ স্তব্ধতা ভেঙে সক্রিয় হয়েছে। সক্রিয় হয়েছে কিছু কিশোর—নতুন প্রজন্ম যারা, এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও, তবে সবচেয়ে বড় কথা, সক্রিয় হয়েছে মানুষের বিবেক, এমনকি প্রকৃতিও। সত্য যে, এই শাস্তি দেওয়াটা একটা রূপকথার আদল দিয়েছে গল্পটাকে, কিন্তু এটি জেগে ওঠা মানুষের রূপকথা, মিলন যার রূপকার। ‘নূরজাহান’-এর শেষে এসে সরাসরি পক্ষ নিয়েছেন মিলন, কিন্তু এই পক্ষ নেওয়ায় গল্পের আড়ালে জেগে থাকা ইতিহাসটা স্বস্তি পেয়েছে, সত্য জেগে উঠেছে।
ছাতকছড়ায় যে নূরজাহান ছিল, সেও মরেছিল ফতোয়ার আঘাতে। মেদিনীমণ্ডলের নূরজাহানও। মিলন একবার পক্ষ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিশ্রম করেছেন তাঁর অবস্থানটি সত্য, ন্যায় ও ধর্মের আলোকে উপস্থাপন করতে। এ জন্য ফতোয়াকে তিনি ইসলামের দৃষ্টি দিয়ে পড়েছেন। অসংখ্য বই পড়েছেন। রীতিমতো গবেষণা করেছেন—যেন তিনি উপন্যাস নয়, একটি অভিসন্দর্ভ লিখেছেন। কত অভিনিবেশ নিয়ে তিনি ইসলামের নীতি ও বাণীগুলো খুঁটিয়ে পড়েছেন, মহানবী (সা.)-এর জীবনী ও হাদিস পড়েছেন, ধর্মের ব্যাখ্যা এবং ইসলামে নারীর অধিকার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন। ধর্মের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল, কারণ তিনি সেই লোকজ ঐতিহ্যে বেড়ে উঠেছেন, যা ধর্মের সত্যিকার সারটুকু গ্রহণ করে, এবং করে সমৃদ্ধ হয়। তাঁর এই উপন্যাসে মান্নান মাওলানার এক বিপরীত চরিত্র আছেন, মাওলানা মহিউদ্দিন, যিনি ইসলামের মূল্যবোধগুলো ধারণ করে এক শীতল ছায়া মেলে ধরেন প্রতিটি মানুষের মাথায়। মান্নান মাওলানা গ্রামের ছনু বুড়ি মারা গেলে তার জানাজা পড়াতে অস্বীকার করল, যেহেতু ছনু বুড়ি টুকটাক চুরি করে, যদিও পেটের দায়ে। মাওলানা মহিউদ্দিন তার জানাজা পড়ালেন, তার ছেলেকে সান্ত্বনা দিলেন। তাঁকে দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়।
মাওলানা মহিউদ্দিনের চরিত্র কি তাহলে একটা ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস, এ কথা প্রমাণ করতে যে মান্নান মাওলানারা ব্যতিক্রম, মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবরাই নিয়ম। না, এর কোনোটিই না। মিলন কোনো শ্রেণি নয়, মানুষ ধরে ধরে এগোন। তাঁর প্রতিটি মানুষই আলাদা। মাওলানা মহিউদ্দিন তেমনই এক মানুষ। প্রথমত তিনি মানুষ, ভালো মানুষ, যেমন দবির গাছি ভালো মানুষ, মরণি ভালো মানুষ, ফুলমতি ভালো মানুষ। তারপর তাঁর কিছু দায়িত্ব আছে, তিনি মসজিদের ইমাম। সেই দায়িত্ব তিনি সুচারুভাবে পালন করেন। দবিরও তার দায়িত্ব পালন করে, মরণিও। মানুষের অবস্থানেই এরা মর্মস্পর্শী।
একই কারণে মান্নান মাওলানার পরাজয়টা বাস্তবকে পাশ কাটিয়ে রূপকথার অঞ্চলে চলে গেলেও এক হিসাবে এই পরাজয়ের কারণটা তার মানুষ হিসেবে অকৃতকার্য হওয়ার জন্য। আতাহারও শক্তিশালী ছিল, কপট ও ভণ্ড ছিল; সে মদ খায়, বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে শয্যাসঙ্গী করে সন্তানও উৎপাদন করে, এবং স্বার্থপরতার প্রয়োজনে বাবার কুকর্মকে সমর্থন করে। কিন্তু যেদিন তার মা তার মিথ্যাবাদিতার প্রমাণ পেয়ে (এবং একই সঙ্গে স্বামীর মিথ্যাবাদিতার নতুন কিস্তির সন্ধান পেয়ে) অবিশ্বাস ও ঘৃণা নিয়ে হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতায় মারা গেলেন, সেদিন আতাহারের মনুষ্যত্বের কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না। মাওলানাবাড়ির বঞ্চনায় পোড়া অতৃপ্ত পারুকে অনেক দিন আতাহার তার অধিকারে রেখে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে তার সঙ্গে। কিন্তু বাবার বাড়ি ফেরত যাওয়া পারু তাকে পথ দেখিয়ে দিল। তার শত অনুনয়েও পারুর মন গলল না, বরং আতাহার ও তার বাবাকে ‘গুয়ের পোকা’ অভিধা দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিল। আতাহার কাঁদল, কপাল চাপড়াল, কিন্তু পারুর অবস্থানের উনিশ-বিশ হলো না। গুয়ের পোকাই বটে, মনুষ্যত্বের ছিটেফোঁটা না থাকলে এ রকমই তো হওয়ার কথা।
ঠিকই পরাজিত হলো আলী আমজাদও। উপন্যাসের শুরুতে সেও ছিল অপ্রতিরোধ্য। নূরজাহান তাকে চিনেছিল, কিন্তু কিশোরী নূরজাহান তখনো তার জগৎটাকে দেখছে মাওয়া সড়কের মতো এক বিস্ময় হিসেবে—যেন দূরের জগতের সঙ্গে এক বিস্ময়কর যোগাযোগ অপেক্ষা করছে তার জন্যও। আমজাদেরও কুদৃষ্টি পড়েছিল নূরজাহানের ওপর, কিন্তু ভাগ্য মেয়েটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, তবে আমজাদের নিষ্ঠুরতার বলি হতে হয়েছে বদর ও হেকমতকে এবং এক দুর্ঘটনায় তারই সড়ক নির্মাণের শ্রমিকদের ফেলা মাটিতে চাপা পড়ে মারা যাওয়া মজনুর বাবা আদিলদ্দিকে। আদিল নামাজ পড়তে ঢালের দিকে বসেছিল। একসময় আমজাদের বাড়তে থাকা পাপ তাকে কাবু করেছে। সেও পরাজিত হয়েছে, নিজের লোভ ও ক্ষমতার নির্মমতার কাছে।
ইংরেজিতে যাকে ‘ক্যামিও’ বলে, সে রকম একঝলক দেখা দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে আরেক অমানুষ, রিকশাচালক রুস্তম। গ্রামের পাগলি মেয়ে তছিকে সে ফুসলিয়ে রিকশায় চড়িয়ে নিয়ে গেছে এক বাজারে মুরলিভাজা কিনে দেওয়ার জন্য। সেখানে সে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে অরক্ষিত ওই মেয়েটিকে। কিন্তু তছি সাধারণ মানুষ নয়, তার অতিমানুষি কিছু শক্তি আছে, অমানুষ হতে থাকা একটি পাষণ্ডের জন্য যা ভয়ংকর। রুস্তম পরাজিত হয় তার লালসার কাছে, তছি হয় তার শাস্তির নিমিত্ত। তবে তছির জীবনও তারপর পাল্টে যায়। পাগল হোক যা-ই হোক, জীবনবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর একটি-দুটি অন্তত সে বুঝতে পারে, বাস্তবের আইন আর অপরাধ-শাস্তির দু-এক ধারা সম্পর্কেও তার ধারণা আছে। তবে আমার শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল, তছি পুলিশের হাতে পড়বে না। কারণ তছি পুলিশের চালাক পৃথিবী আর আইনের ছোট-লম্বা হাতের মাপের বাইরের এক অস্তিত্বের নাম।
‘নূরজাহান’: সময়কে ছাড়িয়ে যায় যে গল্প
সিলেটের মৌলভীবাজারের ছাতকছড়ায় একটি মেয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। সেই ‘অপরাধে’ তাকে শাস্তি দিয়ে ফতোয়া দিলেন গ্রামের মসজিদের ইমাম।
মেয়েটিকে বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর ছোড়া হলো। পাথর তার মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত করে দিল, কিন্তু তার থেকে বেশি ক্ষতবিক্ষত করল তার আত্মসম্মানবোধকে, মানুষ হিসেবে তার পরিচিতিকে এবং সমাজ, মানুষ ও ধর্মের ওপর তার বিশ্বাসকে। এক বিশাল অবিশ্বাস এবং অপমানের ভার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করল।
আমাদের সকলের মতো ইমদাদুল হক মিলনের মনেও ঘটনাটি গভীর দাগ কাটল। মেয়েটির জন্য তাঁর গভীর মমতা হলো; যে ইমামের ফতোয়া মেয়েটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল, তার প্রতি তাঁর ঘৃণা জাগল। কিন্তু মেয়েটিকে তাঁর সহানুভূতি, তাঁর ভালোবাসা যে জানাবেন, তার কোনো উপায় নেই। মসজিদের ওই ইমামকে তিনি হয়তো তাঁর ঘৃণার কথা জানাতে পারতেন, কিন্তু তাতে তার কোনো বিকার হতো, তার বিবেক আর অপরাধবোধ জাগত—তেমন সম্ভাবনা ছিল না। মিলন সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি একটি উপন্যাসে মেয়েটিকে আঁকবেন, পাঠকের মনে চিরকালের জন্য একটা জায়গা তাকে করে দেবেন। আর নিষ্ঠুর ইমামকে তিনি পাঠকের আদালতে হাজির করবেন দিনের পর দিন, তারা তাকে শাস্তি দেবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ যা, আমাদের চারদিকে প্রচুর বিপন্নতা নিয়ে বেঁচে থাকা বাস্তব জীবনের এ রকম মেয়েগুলোকে পাঠকরা সুরক্ষা দেবে, বাস্তবের বিবেকহীন হন্তারকগুলোকে তারা প্রতিরোধ করবে। একটি উপন্যাসের অনেক শক্তি, অনেক দূর সে যেতে পারে। পাঠককে জাগাতে পারে। তাকে শুদ্ধ করতে পারে।
মিলন তাঁর লেখার শক্তিতে বিশ্বাসী, সে জন্য তাঁর লেখা পাঠককে স্পর্শ করে। যেমন তাঁর ‘পরাধীনতা’ আমাকে স্পর্শ করেছিল, এবং আমি স্পর্শিত হওয়ার কথাটা লিখে বর্ণনা করেছিলাম। তাঁর ‘নূরজাহান’ও আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। অনেক দিন পর এ বইটি নিয়ে লিখছি, যদিও মিলনের অনেক উপন্যাস আমি পড়েছি, নানা মাত্রায় সেগুলোর অভিঘাত আমি উপলব্ধি করেছি; কিন্তু ‘নূরজাহান’ এগুলোর চেয়ে কিছুটা ভিন্ন, যার প্রধান কারণ এর এপিক বিস্তার। তবে উপন্যাসটির প্রায় ১১০০ পৃষ্ঠার কলেবর এই বিস্তার তৈরি করেনি, করেছে মিলনের কল্পনার বিশালতা—এক সামান্য গ্রামের অসামান্য এক জীবনচিত্রকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সচল রাখার তাঁর ক্ষমতা; এক বিশাল ক্যানভাসে অসংখ্য চরিত্রকে তাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত আর সামষ্টিক জীবন নিয়ে হাজির করা, ছোট ছোট ঘটনা দিয়ে ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তের দিকে গল্পরেখাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আর মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি আর ঋতুবদলের ভেতরের রসায়নগুলোকে সম্পৃক্ত করার তাঁর দক্ষতা। মিলন সংবেদী লেখক, তিনি একটা কোমল হাত রাখেন তাঁর অকিঞ্চিৎকর সব চরিত্রের পিঠে, তাদের আনন্দে হাসেন, তাদের দুঃখে কাঁদেন। কিন্তু তাঁর বর্ণনায় এর প্রকাশ্য ছায়াপাত ঘটাতে দেন না। তিনি অনেক ঘটনায় নিজেকেও বিনিয়োগ করেন, তাঁর পক্ষপাতিত্ব আমরা টের পাই, তাঁর ক্রোধ অথবা পুলক আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু সেগুলো গল্পের একটা গভীরেই শুধু সক্রিয় হয়। গল্প বলায় তিনি একটা বস্তুনিষ্ঠতা মেনে চলেন। ফলে পাঠক একটি ঘটনার অনিবার্যতাকে যেমন বাস্তবের কার্যকারণ সূত্রে ফেলে মাপতে পারেন, তেমনি এর পেছনে লেখকের পক্ষগ্রহণের বিষয়টিও অনুধাবন করেন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে, উদাহরণটি ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের শেষ দিক থেকে নেওয়া (শুরুর থেকে উদাহরণ দিলে হয়তো যথাযথ হতো, কিন্তু শেষ দিকের উদাহরণটি এমনই প্রাসঙ্গিক আমার ওপরের বক্তব্যের সঙ্গে যে তা দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না)।
নূরজাহানকে ফতোয়া দিয়ে দুজন শাগরেদ লাগিয়ে তাকে একটা গর্তে পুরে মসজিদ বানানোর খোয়া-সুরকি ছুড়ে মাওলানা মান্নান তার প্রতিহিংসা মেটাল। নূরজাহানের মুখ ও মাথা রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হলো, সে একসময় টলতে টলতে উঠে বাড়ি গিয়ে অ্যানড্রিন খেল, এবং তার মারা যাওয়ার পর মেদিনীমণ্ডলের দৃশ্যপট বদলে গেল। পুলিশ এলো এবং মাওলানা মান্নানকে ধরে নিয়ে গেল কোমরে দড়ি দিয়ে, যে রকম দড়ি দিয়ে নিষ্পাপ মাকুন্দা কাশেমকে সে চোর সাজিয়ে গ্রাম থেকে বিদেয় করে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের এক কর্তা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, এবার রাজাকার মাওলানাকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পিছু পিছু তাড়া করে আসা বাদলা নাদের হামেদ আলালদ্দি বারেকের মতো কিশোর তরুণরা পাষণ্ড মাওলানাকে যখন ঢিল ছুড়ে মারছে, সে কিছুই বলল না। মাওলানার মুখে-মাথায় ঢিল পড়তে দিল। মিলন এরপর লেখেন, “আর কথা নাই। হালটের পাশ থেকে তুমুল ক্রোধে বৃষ্টির মতন চাকা পড়তে লাগলো মান্নান মাওলানার মুখে। হাত তুইলা, মুখ নিচা কইরা, চিৎকার চেঁচামেচি কইরা নানানভাবে পোলাপানের চাকার হাত থেকে নিজেরে রক্ষা করতে চাইলো, পারলো না। ” এই বর্ণনা কি কোনো চরিত্র দিচ্ছে? না, দিচ্ছেন লেখক। কিন্তু তিনিই তো এর অনেক আগে মান্নান মাওলানা আর তার ছেলে আতাহারের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার মাকুন্দা কাশেমের ভয়ার্ত আর্তনাদ এবং সেই আর্তনাদে তার শেষ হতে যাওয়া আয়ু কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখার নিষ্ফল চেষ্টার পর লিখেছিলেন, “মাকুন্দা কাশেমের বুকফাটা আর্তনাদে তখন স্তব্ধ হয়েছিল জেগে ওঠা মানুষ, ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছিল শীতরাত্রির নিস্তব্ধতা। ” এই ভাষিক পরিবর্তন কেন? কিশোর-তরুণদের হাতে মান্নান মাওলানার শাস্তি পাবার দৃশ্যে কেন তিনি চলে গেলেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের ভাষায়, ক্ষণিক ছুটি নিলেন সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীর অবস্থান থেকে, হয়ে গেলেন বাদলা নাদের হামেদদের একজন?
উদাহরণটি আমি দিয়েছি লেখকের পক্ষগ্রহণের প্রসঙ্গে। রাজনীতিতে যেমন শেষ বিচারে নিরপেক্ষতা বলে কেউ নেই—যিনি একটি নির্বাচনে ভোট দিতে যান না, তিনিও একটি পক্ষ নেন, হয়তো নির্বাচনের অসারতার বিপক্ষেই—লেখালেখিতেও নিরপেক্ষতা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র। যাঁরা সমাজ নিয়ে লেখেন, সমাজের অসংগতি-অবিচার আর স্খলন-পতন নিয়ে লেখেন, তাঁরা ক্ষমতার আর বিত্তের বিপরীতে থাকা মানুষগুলোরই পক্ষ নেন। এই পক্ষগ্রহণ বেশির ভাগই প্রচ্ছন্ন; প্রায়ই তার আয়োজন থাকে না, উত্তেজনাও থাকে না। মিলনও অনেক উপন্যাসে এই পক্ষপাত প্রচ্ছন্নই রাখেন, কিন্তু ‘পরাধীনতা’ ও ‘নূরজাহান’-এ এটি অনেকটাই স্পষ্ট। ‘পরাধীনতা’য় দুই পক্ষ ছিল, অথবা দুটি পক্ষের অনেক রূপ ছিল—দেশ-বিদেশ, মুক্তি-অন্তরিনতা, বস্তুর নিগড়-কল্পনার উড়াল, যন্ত্র-মানুষ। ‘নূরজাহান’-এ মিলন নিজে আছেন, এবং তাঁর যে সত্তার আড়ালে বর্ণনাকারী তার গল্প বুনে যায়, নিঃশব্দে জাল বুনে যাওয়া কোনো মাকড়সার মতো, সে নিজেই তো রক্তাক্ত। রূঢ় বাস্তব, বাস্তবের কল্পনা আর কল্পনার বাস্তব এমন অনিবার্যভাবে মিলে যায় এই উপন্যাসে যে, কোনো ঘটনাকেই আর কল্পিত মনে হয় না।
‘নূরজাহান’-এর গল্প জীবন পায় মিলনের চেনা অন্তরঙ্গ ভূগোলে, তাঁর নিজের উঠানে। এই উঠানে তাঁর অধিকার ষোলো আনা। এর চরিত্ররা তাঁর চেনা, এর গাছপালা বিছিয়ে থাকে তার করতলে। এই উঠানে যখন কোনো অপচ্ছায়া পড়ে, একটি দুরন্ত কিশোরীকে বেঁধে ফেলে তার অপরিষ্কার শেকলে, তখন তিনিও জেগে ওঠেন। ‘নূরজাহান’ এ জন্য এত টানে আমাদের। আধুনিক সাহিত্যের তাত্ত্বিকরা বলবেন, ওই পক্ষগ্রহণ গল্পের জন্য ক্ষতিকর; উত্তরাধুনিক তত্ত্বের প্রবক্তারা বলবেন, এতে কোনো দোষ নেই—বস্তুত গল্পকে তা মানবিক করে। মিলন উত্তরাধুনিক লেখক নন, কিন্তু তিনি গল্প বলার ঐতিহ্যকে ধারণ করেন। সেই ঐতিহ্যে পক্ষগ্রহণ একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে বিষয়টা আরো গভীর—এবং তা হচ্ছে, পক্ষগ্রহণে গল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় কি না!
মিলন দেখান, ক্ষতি নয়, তাতে লাভ হয়। একটা বিশাল ক্যানভাসের কাজ একটা জায়গা খুঁজে পায়। নূরজাহানের পুনর্জন্ম হয়, পাঠকের চেতনায়। পৃথিবীর সব মান্নান মাওলানা একজোট হয়েও তাকে আর মারতে পারে না।
‘নূরজাহান’-এর শেষ অংশটি আমার বিস্ময় জাগিয়েছে। মিলন যেভাবে ঋতু ধরে ধরে অগ্রসর হয়ে মেদিনীমণ্ডল গ্রামটির একটি চালচিত্র মেলে ধরেছেন, তাতে মান্নান মাওলানার চরিত্রটি অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছে। মাকুন্দা কাশেমকে পিটিয়ে মৃতপ্রায় করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার পর তার অবস্থান আরো পোক্ত হয়েছে। এই উপন্যাসের খল চরিত্রগুলো প্রায় সবাই একটা অপ্রতিরোধ্য অবস্থানে চলে যায়। আতাহার, সড়কের কন্ট্রাক্টর আলী আমজাদ এবং আতাহারের সাঙ্গোপাঙ্গকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে তেমন মনে হয় না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তাদের পরাজিত হওয়া তো দূরের কথা, তাদের কেউ বিপদে ফেলতে পারে, সে রকম ভাবারও কথা নয়। কিন্তু সবাই তারা হেরে যায়। মান্নান মাওলানার মুখে যেদিন নূরজাহান থুতু ছিটিয়ে দিল, সেদিন থেকেই তার সেই পরাজয়। ধূর্ত ও নিষ্ঠুর এই মাওলানা এরপর প্রতিশোধ নিতে নামল। তার পরিকল্পনা ধরে সে এগোল। দেলোয়ারার ভালোমানুষি এবং এনামুলের বদান্যতায় সে একটি মসজিদের ইমাম হলো। এর আগে সে নূরজাহানকে স্ত্রী হিসেবে অধিকারের চেষ্টা করে বিফল হলেও প্রতিশোধটা সে ঠিকই নিল। তার বিরুদ্ধে একটা ফতোয়া দিয়ে নিজেই বসল বিচারে। এইখানে এসে মিলনের জন্য দুটি পথ খোলা ছিল—তিনি বাস্তবকে মেনে নিয়ে মান্নান মাওলানাকে তার বিজয়মুহূর্তে ছেড়ে দিতে পারতেন, এবং নূরজাহানকে এক হতভাগ্য ও ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবে তার করুণ পরিণতির কাছে সমর্পণ করতে পারতেন, যা পাঠককে একসময় একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বলতে বাধ্য করত, “এ আর এমন কী, বাংলাদেশের নূরজাহানদের কপালে এই তো লেখা থাকে, আর বাংলাদেশের মান্নান মাওলানাদের এমনই তরক্কি হয়”; অথবা মান্নান মাওলানার পরাজয়টা দেখাতে পারতেন। তিনি দ্বিতীয় পথটা শুধু বেছে নেননি, এই পরাজয়কে একটা প্রতীকী মাত্রায় বাংলাদেশের জেগে ওঠা হিসেবেও দেখিয়েছেন। মাকুন্দা কাশেমের মৃত্যুর সময় জেগে ওঠা মানুষ স্তব্ধ হয়ে ছিল, মান্নান মাওলানার শাস্তি নিশ্চিত করার সময় জেগে থাকা মানুষ স্তব্ধতা ভেঙে সক্রিয় হয়েছে। সক্রিয় হয়েছে কিছু কিশোর—নতুন প্রজন্ম যারা, এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও, তবে সবচেয়ে বড় কথা, সক্রিয় হয়েছে মানুষের বিবেক, এমনকি প্রকৃতিও। সত্য যে, এই শাস্তি দেওয়াটা একটা রূপকথার আদল দিয়েছে গল্পটাকে, কিন্তু এটি জেগে ওঠা মানুষের রূপকথা, মিলন যার রূপকার। ‘নূরজাহান’-এর শেষে এসে সরাসরি পক্ষ নিয়েছেন মিলন, কিন্তু এই পক্ষ নেওয়ায় গল্পের আড়ালে জেগে থাকা ইতিহাসটা স্বস্তি পেয়েছে, সত্য জেগে উঠেছে।
ছাতকছড়ায় যে নূরজাহান ছিল, সেও মরেছিল ফতোয়ার আঘাতে। মেদিনীমণ্ডলের নূরজাহানও। মিলন একবার পক্ষ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিশ্রম করেছেন তাঁর অবস্থানটি সত্য, ন্যায় ও ধর্মের আলোকে উপস্থাপন করতে। এ জন্য ফতোয়াকে তিনি ইসলামের দৃষ্টি দিয়ে পড়েছেন। অসংখ্য বই পড়েছেন। রীতিমতো গবেষণা করেছেন—যেন তিনি উপন্যাস নয়, একটি অভিসন্দর্ভ লিখেছেন। কত অভিনিবেশ নিয়ে তিনি ইসলামের নীতি ও বাণীগুলো খুঁটিয়ে পড়েছেন, মহানবী (সা.)-এর জীবনী ও হাদিস পড়েছেন, ধর্মের ব্যাখ্যা এবং ইসলামে নারীর অধিকার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন। ধর্মের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল, কারণ তিনি সেই লোকজ ঐতিহ্যে বেড়ে উঠেছেন, যা ধর্মের সত্যিকার সারটুকু গ্রহণ করে, এবং করে সমৃদ্ধ হয়। তাঁর এই উপন্যাসে মান্নান মাওলানার এক বিপরীত চরিত্র আছেন, মাওলানা মহিউদ্দিন, যিনি ইসলামের মূল্যবোধগুলো ধারণ করে এক শীতল ছায়া মেলে ধরেন প্রতিটি মানুষের মাথায়। মান্নান মাওলানা গ্রামের ছনু বুড়ি মারা গেলে তার জানাজা পড়াতে অস্বীকার করল, যেহেতু ছনু বুড়ি টুকটাক চুরি করে, যদিও পেটের দায়ে। মাওলানা মহিউদ্দিন তার জানাজা পড়ালেন, তার ছেলেকে সান্ত্বনা দিলেন। তাঁকে দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়।
মাওলানা মহিউদ্দিনের চরিত্র কি তাহলে একটা ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস, এ কথা প্রমাণ করতে যে মান্নান মাওলানারা ব্যতিক্রম, মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবরাই নিয়ম। না, এর কোনোটিই না। মিলন কোনো শ্রেণি নয়, মানুষ ধরে ধরে এগোন। তাঁর প্রতিটি মানুষই আলাদা। মাওলানা মহিউদ্দিন তেমনই এক মানুষ। প্রথমত তিনি মানুষ, ভালো মানুষ, যেমন দবির গাছি ভালো মানুষ, মরণি ভালো মানুষ, ফুলমতি ভালো মানুষ। তারপর তাঁর কিছু দায়িত্ব আছে, তিনি মসজিদের ইমাম। সেই দায়িত্ব তিনি সুচারুভাবে পালন করেন। দবিরও তার দায়িত্ব পালন করে, মরণিও। মানুষের অবস্থানেই এরা মর্মস্পর্শী।
একই কারণে মান্নান মাওলানার পরাজয়টা বাস্তবকে পাশ কাটিয়ে রূপকথার অঞ্চলে চলে গেলেও এক হিসাবে এই পরাজয়ের কারণটা তার মানুষ হিসেবে অকৃতকার্য হওয়ার জন্য। আতাহারও শক্তিশালী ছিল, কপট ও ভণ্ড ছিল; সে মদ খায়, বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে শয্যাসঙ্গী করে সন্তানও উৎপাদন করে, এবং স্বার্থপরতার প্রয়োজনে বাবার কুকর্মকে সমর্থন করে। কিন্তু যেদিন তার মা তার মিথ্যাবাদিতার প্রমাণ পেয়ে (এবং একই সঙ্গে স্বামীর মিথ্যাবাদিতার নতুন কিস্তির সন্ধান পেয়ে) অবিশ্বাস ও ঘৃণা নিয়ে হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতায় মারা গেলেন, সেদিন আতাহারের মনুষ্যত্বের কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না। মাওলানাবাড়ির বঞ্চনায় পোড়া অতৃপ্ত পারুকে অনেক দিন আতাহার তার অধিকারে রেখে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে তার সঙ্গে। কিন্তু বাবার বাড়ি ফেরত যাওয়া পারু তাকে পথ দেখিয়ে দিল। তার শত অনুনয়েও পারুর মন গলল না, বরং আতাহার ও তার বাবাকে ‘গুয়ের পোকা’ অভিধা দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিল। আতাহার কাঁদল, কপাল চাপড়াল, কিন্তু পারুর অবস্থানের উনিশ-বিশ হলো না। গুয়ের পোকাই বটে, মনুষ্যত্বের ছিটেফোঁটা না থাকলে এ রকমই তো হওয়ার কথা।
ঠিকই পরাজিত হলো আলী আমজাদও। উপন্যাসের শুরুতে সেও ছিল অপ্রতিরোধ্য। নূরজাহান তাকে চিনেছিল, কিন্তু কিশোরী নূরজাহান তখনো তার জগৎটাকে দেখছে মাওয়া সড়কের মতো এক বিস্ময় হিসেবে—যেন দূরের জগতের সঙ্গে এক বিস্ময়কর যোগাযোগ অপেক্ষা করছে তার জন্যও। আমজাদেরও কুদৃষ্টি পড়েছিল নূরজাহানের ওপর, কিন্তু ভাগ্য মেয়েটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, তবে আমজাদের নিষ্ঠুরতার বলি হতে হয়েছে বদর ও হেকমতকে এবং এক দুর্ঘটনায় তারই সড়ক নির্মাণের শ্রমিকদের ফেলা মাটিতে চাপা পড়ে মারা যাওয়া মজনুর বাবা আদিলদ্দিকে। আদিল নামাজ পড়তে ঢালের দিকে বসেছিল। একসময় আমজাদের বাড়তে থাকা পাপ তাকে কাবু করেছে। সেও পরাজিত হয়েছে, নিজের লোভ ও ক্ষমতার নির্মমতার কাছে।
ইংরেজিতে যাকে ‘ক্যামিও’ বলে, সে রকম একঝলক দেখা দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে আরেক অমানুষ, রিকশাচালক রুস্তম। গ্রামের পাগলি মেয়ে তছিকে সে ফুসলিয়ে রিকশায় চড়িয়ে নিয়ে গেছে এক বাজারে মুরলিভাজা কিনে দেওয়ার জন্য। সেখানে সে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে অরক্ষিত ওই মেয়েটিকে। কিন্তু তছি সাধারণ মানুষ নয়, তার অতিমানুষি কিছু শক্তি আছে, অমানুষ হতে থাকা একটি পাষণ্ডের জন্য যা ভয়ংকর। রুস্তম পরাজিত হয় তার লালসার কাছে, তছি হয় তার শাস্তির নিমিত্ত। তবে তছির জীবনও তারপর পাল্টে যায়। পাগল হোক যা-ই হোক, জীবনবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর একটি-দুটি অন্তত সে বুঝতে পারে, বাস্তবের আইন আর অপরাধ-শাস্তির দু-এক ধারা সম্পর্কেও তার ধারণা আছে। তবে আমার শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল, তছি পুলিশের হাতে পড়বে না। কারণ তছি পুলিশের চালাক পৃথিবী আর আইনের ছোট-লম্বা হাতের মাপের বাইরের এক অস্তিত্বের নাম।
সম্পাদক ও প্রকাশক
শেখ জাহিদ হোসেন
নির্বাহী সম্পাদক
আলহাজ্ব শেখ সিদ্দিকুর রহমান
বার্তা সম্পাদক
তাকছিমুন নাহার
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
ইঞ্জিনিয়ার কে এম মেহেদী হাসান |
মোবাইল: ০১৭১১২৪৯৭৭০
হোয়াটস্অ্যাপ: ০১৭১১২৪৯৭৭০
প্রধান কার্যালয় মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
|
প্রিন্টের তারিখ ও সময়: December 5, 2024, 6:58 am