কক্সবাজারে অপহরণ আতঙ্ক, পাহাড়ে নির্যাতন করে নেওয়া হয় মুক্তিপণ

  বিশেষ প্রতিনিধি    12-01-2023    161
কক্সবাজারে অপহরণ আতঙ্ক, পাহাড়ে নির্যাতন করে নেওয়া হয় মুক্তিপণ

অভিনব কৌশলে কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এই অপহরণ-বাণিজ্য ঘিরে সক্রিয় অন্তত ১০ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। অপহরণের পর টেকনাফের পাহাড়-জঙ্গলের আস্তানায় নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে তারা।

টেকনাফের বাহারছাড়া, হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নে অপহরণ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। একের পর এক ঘটনা ঘটলেও কারা অপহরণে জড়িত তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে অপহরণকারীরা। অপহরণের পর মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। ফেরত আসা ব্যক্তিরা প্রাণনাশের ভয়ে অপহরণকারীদের সম্পর্কে কিছু বলছেন না। ফলে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, এসব অপহরণের ঘটনায় কারা জড়িত?

অপহরণে জড়িত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা

সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি সকালে হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকা থেকে চার কৃষককে অপহরণ করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তারা হলেন লেচুয়াপ্রাং গ্রামের আবদুস সালাম, আবদুর রহমান এবং দুই ভাই মুহিব উল্লাহ ও আবদুল হাকিম। এর মধ্যে মঙ্গলবার রাতে হ্নীলা পাহাড়ি এলাকা থেকে তিন জন ছয় লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন। বুধবার (১১ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় আবদুস সালাম ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আবদুস সালামের পরিবার।

টেকনাফ-৪ জাহজপুরায় আট জনকে অপহরণের পর পাহাড়ে অভিযান চালায় পুলিশ

এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর বিকালে টেকনাফের জাহাজপুরা পাহাড়ের খালে মাছ ধরতে গেলে কলেজশিক্ষার্থীসহ আট জনকে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। পরে নির্যাতনের শিকার হয়ে তিন দিন পর ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান তারা। এদের মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসা একজন নুরুল আবছার। তিনি বলেন, ‘মুক্তিপণের জন্য আমাদের যে ধরনের নির্যাতন করা হয়েছিল, তা অবর্ণনীয়। এখনও আমার পুরো শরীর ব্যথা। ঘুমের মধ্যে শিউরে উঠি। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা খুব ভয়ঙ্কর। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছি। তাদের কাছে ল্যাপটপসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি আছে। তাদের বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। পাহাড়ে থাকলেও সব খবর রাখে তারা।’

অপহরণের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিরা আমাদের উদ্ধারে গেলে নির্যাতন বাড়িয়ে দেয় জানিয়ে নুরুল আবছার বলেন, ‘আমাদের হাত-পা ও চোখ-মুখ বেঁধে মারধর করা হয়। মুক্তিপণ আদায়ে যত ধরনের নির্যাতন আছে, সবগুলো প্রয়োগ করেছে তারা। অভিযানের কারণে যদি মুক্তিপণ না পায় তখন হত্যার হুমকি দিয়ে অপহৃতদের ছেড়ে দেয়।’

পুলিশ ও অপহৃতদের পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, টেকনাফে গত সেপ্টেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫২টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১২টি অপহরণের বিষয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগীদের পরিবার।

ভুক্তভোগী কয়েকজনের পরিবার জানায়, বেশিরভাগ ঘটনায় অপহরণকারীদের সঙ্গে দফারফা শেষে মুক্তিপণ দিয়ে অপহৃতদের ছাড়িয়ে এনেছেন স্বজনরা। পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েও অপহৃতরা উদ্ধার না হওয়ায় মুক্তিপণ দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

টেকনাফ-২ অপহরণের পর টেকনাফের পাহাড়-জঙ্গলের আস্তানায় নিয়ে মুক্তিপণ আদায়

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিন ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং ও হ্নীলা ইউনিয়নে প্রতিদিনই অপহরণের ঘটনা ঘটছে। শুধু হ্নীলা ইউনিয়নে গত চার মাসে ২০টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে অপহৃতদের ছাড়ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।

টাকা ছাড়া মুক্তি মেলে না

অহরহ অপহরণের ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন উল্লেখ করে হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, ‘আমরা সবাই আতঙ্কে আছি। গত কয়েক মাসে আমার এলাকায় ২০টির মতো অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এদের সবাই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি জানালেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।’

পুলিশকে জানালে কিংবা মুক্তিপণ দিতে দেরি হলে অপহৃতদের ওপর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা নির্যাতন বাড়িয়ে দেয় উল্লেখ করে চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, ‘৮ জানুয়ারি আমার এলাকার চার কৃষককে অপহরণ করা হয়। তাদের উদ্ধারে আমরা পাহাড়ে যাই। খবর পেয়ে অপহৃতদের ওপর নির্যাতন বাড়িয়ে দেয় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ওই সময় সন্ত্রাসীরা আমাদের বলেছিল, “এখানে পুলিশ ও জনপ্রতিনিধির কাজ কি? এরপর এখানে এলে অপহৃতদের হত্যা করে লাশ গুম করে দেওয়া হবে”।’

জাহাজপুরায় আট এবং লেচুয়াপ্রাংয়ে চার জন অপহরণের ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলে উল্লেখ করেছেন চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, ‘মূলত পাহাড়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির সহায়তায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা মুক্তিপণ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় জায়গা বদলে বদলে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের নির্মূল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযানের বিকল্প নেই।’

শতাধিক ব্যক্তিকে অহপরণ

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির সমন্বয়ে কয়েকটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গঠিত হয়েছে। বর্তমানে এসব গোষ্ঠী টেকনাফের উনচিপ্রাংয়ের জুম পাহাড়, মিজ্জির পাহাড় ও গহীন অরণ্যে অবস্থান করছে। সেখানে আস্তানা গড়ে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে যাচ্ছে। একইসঙ্গে মাদক ও মানব পাচার চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কাজে তথ্যপ্রযুক্তি ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে তারা। এ পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে অহপরণ করেছে। যাদের বেশিরভাগ মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন।

টেকনাফ-১ রোহিঙ্গা ক্যাম্প অপহরণে ১০ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জড়িত

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এসব অপহরণের ঘটনায় অন্তত ১০টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জড়িত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে পাহাড়-জঙ্গলে অবস্থান নেয় সন্ত্রাসীরা। অর্থের জোগান পেতে স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়িতে লুটপাট ও লোকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ে নেমেছে তারা। এরই মধ্যে এসব গোষ্ঠীর অনেকের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তারা হলো—জাহেদ হোসেন (৩৩), শফি উল্লাহ (৩২), আবু হুরায়রা (৩৬), আবুল বশর (৩০), মকবুল আহমদ (৩০), মো. রুবেল (২২), আব্দুর রহমান (৩২), মো. ফিরোজ (৩৫), আবু ছিদ্দিক (২৮), মো. হোসেন ওরফে মাছন (৪৫), আয়াতুল তমজিদ (২৫), সিরাজুল মাঝি ওরফে বার্মাইয়া সিরাজ (৩৫), মো. ইসমাইল (২৪), জয়নাল (৩০), ফরিদ আহাম্মদ (৪০), ওসমান গণি (২০), ফরিদ আহমদ (২৬), মো. হাছন (৩৮), শহিদ উল্লাহ (২৫), মো. রিয়াজ (২২), মিজানুর রহমান (২৫), নুর মোহাম্মদ (৩৫), মনির আহাম্মদ (৩০) ও মোহাম্মদ আলী (২২)। তাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে কেউ না কেউ অপহরণের শিকার হন। অপহরণের আগে তারা রেকি করে, কাকে কোথায় থেকে অপহরণ করবে, সে পরিকল্পনা করা হয়। এরপর সুযোগ বুঝে নির্দিষ্ট সময়ে অপহরণ করে নিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে দিনদুপুরে অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে পাহাড় থেকে এসে স্থানীয়দের ধরে নিয়ে যায়। পরে পাহাড়ের আস্তানায় আটকে পরিবারকে মুক্তিপণের জন্য ফোন দেয়। অনেক পরিবার ধারদেনা, গরু-ছাগল ও ভিটেমাটি বিক্রি করে মুক্তিপণ দিয়ে স্বজনদের ছাড়িয়ে আনছেন। মুক্তিপণ না দিলে চলে ভয়াবহ নির্যাতন। তাদের কাছে রয়েছে ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন নানা ডিভাইস। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে অপহরণের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের আগাম তথ্য জানতে পারে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। অনেক সময় অভিযানের মুখে অপহৃতদের গুলি করে ফেলে যায়। আবার যারা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরছেন প্রাণভয়ে মুখ খুলছেন না কেউ।

এক হাজারের বেশি পরিবার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের কম্বনিয়াপাড়া মহেশখালিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, সাতঘড়িয়াপাড়া, রইক্ষ্যম এলাকায় এক হাজারের বেশি পরিবার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি। এ পর্যন্ত চার জন স্থানীয় বাসিন্দাকে অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যা করেছে তারা। প্রতিদিনই ঘটে অপহরণের ঘটনা।’

গত ২৯ সেপ্টেম্বর মুক্তিপণ না পেয়ে হ্নীলা ইউনিয়নের পানখালীর বাসিন্দা কৃষক শাহাজাহানকে গুলি করে ফেলে রেখে যায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। একই দিন ওই এলাকার আবু বক্কর ও মেহেদী হাসানকে কুপিয়ে আহত করা হয়।

মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা আবদুস সালাম ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, ওই দিন পাঁচ জনকে অপহরণ করা হয়েছিল। তারা ধান চাষ ও ক্ষেতে কাজ করতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ৭-১০ জন তাদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহরণকারীরা পাঁচ জনের প্রত্যেকের জন্য পাঁচ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে। দুজন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান। টাকা না পেয়ে কৃষক শাহাজাহানকে গুলি, আবু বক্কর ও মেহেদীকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। এরপর ৮ অক্টোবর বাহারছড়ার বড়ডেইল পাড়ার মোহাম্মদ উল্লাহর ছেলে আব্দুর রহমানকে অপহরণের একদিন পর ছেড়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। এ বিষয়ে এখনও মুখ খোলেননি তিনি।

যা বলছে পুলিশ প্রশাসন

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘অপহরণের খবর পেলে পাহাড়ি জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার করা হয়। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের ধরতে তৎপর রয়েছে পুলিশ। তবে তাদের ধরতে স্থানীয়দের সহযোগিতা প্রয়োজন। মুক্তিপণ দেওয়ার আগে আমাদের জানালে তাদের সহজে ধরা যেতো। কিন্তু অনেকে গোপনে মুক্তিপণ দেয়। আমরা পাহাড়ে যৌথ অভিযান চালানোর কথা ভাবছি।’ সুত্র: বাংলাট্রিবিউন

সারাদেশ-এর আরও খবর