নিরিবিলি অরণ্যের ‘লাল ড্রাগন’ অনেক মিষ্টি, দামেও সস্তা

  বিশেষ প্রতিনিধি    11-09-2023    83
নিরিবিলি অরণ্যের ‘লাল ড্রাগন’ অনেক মিষ্টি, দামেও সস্তা

কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কের দুইপাশে ফল বিক্রির দোকান আছে ৬০-৭০টি। সবকটি দোকানে সাজানো বড় আকৃতির লাল ড্রাগন। আগে দোকান সমূহে ড্রাগন আনা হত যশোর ও ঢাকা থেকে। এখন শহরে ফলের বাজার অরণ্যের লাল ড্রাগনের দখলে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, একমাস আগেও শহরের দোকানগুলোতে যশোর ও ঢাকা থেকে আনা ড্রাগনের প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছিল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। অরণ্যের লাল ড্রাগন বাজারে আসায় যশোরের ড্রাগনের চাহিদা কমে গেছে। কারণ অরণ্যের লাল ড্রাগন আকারে ( ওজন) বড়, স্বাদে মিষ্টি এবং দামেও সস্তা।

অরণ্যের ড্রাগন খুঁচরাতে বেচাবিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৫০-৩৮০ টাকা।

গত বৃহস্পতিবার বিকালে শহরের প্রধান সড়কের শিহাব ফল বিতানে গিয়ে দেখা গেছে, আপেল কমলা আঙ্গুরে সঙ্গে ক্রেতারা লাল ড্রাগনও কিনছেন।

দোকানের মালিক সিরাজুল ইসলাম (৪৫) বলেন, এক মাস আগেও তিনি যশোর থেকে আনা ড্রাগন বিক্রি করেন ৫০০-৬০০ টাকাতে। এখন দোকানে অরণ্যের ড্রাগন বিক্রি করছেন ৩৫০-৩৭০ টাকায়। অরণ্যের ড্রাগনের ওজন প্রতিটি ৭০০-৯০০ গ্রাম।

কক্সবাজার ফল ব্যবসায়ী দোকান মালিক সমিতির সভাপতি নওশা মিয়া (৬৫) বলেন, শহরের প্রধান সড়কের দুইপাশে ফলের দোকান আছে ৫০-৬০টি। এসব দোকানে দৈনিক কয়েক মণ ড্রাগন বিক্রি হচ্ছে।

ফুটপাতের দোকানে এবং ফেরী করেও বেচাবিক্রি হচ্ছে অনেক ড্রাগন। তার ৮০ শতাংশ অরণ্যের লাল ড্রাগন।

ড্রাগনে ভরপুর নিরিবিলি অরণ্য

শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে রামু উপজেলার রশিদনগর ইউনিয়নের জেটি রাস্তার মাথা এলাকা। সেখান থেকে উত্তর দিকে দেড়-দুই কিলোমিটার গেলে নজরে পড়ে টিলা শ্রেণির সাত একর জায়গাতে সৃজিত ফলের বাগান ‘ নিরিবিলি অরণ্য’। বাগানের চারপাশে লোকজনের বসতবাড়ি। শখের বসে ‘অরণ্য’ বাগানটি গড়ে তোলেন নিরিবিলি গ্রুপের চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান কাজল।

২৬ বছর আগে নিরিবিলি পোলট্রি লাইভ স্টক করার জন্য জায়গাটি কিনেছিলেন লুৎফর রহমানের মরহুম বাবা ও তৎকালীন নিরিবিলি গ্রুপের প্রতিষ্টাতা চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান। এরপর ওই জমিতে রাবার বাগান করা হয়। ৪ বছর আগে রাবার বাগান কেটে সেখানে ফলমুলের বাগান অরণ্য গড়ে তোলা হয়। গত বছর থেকে অরণ্য থেকে বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন বিক্রি শুরু হয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, অরণ্যের মধ্যভাগে ৮০ শতক ( দুই কানি) জমিতে ড্রাগন চাষ হচ্ছে। বাগানে খুঁটি আছে ২৫০টি। একটি খুঁটিতে চারটি করে ড্রাগন গাছ বাঁধা আছে। প্রতিটা গাছে ঝুঁলছে ৯ থেকে ১৫টা ড্রাগন। ড্রাগনের ওজন ৬০০-৮০০ গ্রাম। ফল পাকতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। পোকা মাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ড্রাগনের উপর মোড়ানো হয় পলিথিন ।

ড্রাগনের পরিচযা করছিলেন চাষি বকুল হোসেন। তাঁর বাড়ি জামালপুর সদরের গোরাদাপ ইউনিয়নে। জামালপুরে ড্রাগন চাষ করেন পাঁচ-ছয় বছর।

তিন বছর ধরে অরণ্যে ড্রাগন চাষ করছেন জানিয়ে বকুল হোসেন (৪০) বলেন, অরণ্যের বেলে মাটি ড্রাগন চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত। ঠিকমত পরিচযা করায় গাছে ড্রাগনের ফলন ভালো হচ্ছে। ৮০ শতাংশ ড্রাগনের ওজন ৮০০-৯০০ গ্রাম। বাগানে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ গ্রাম ওজনের ড্রাগনও পাওয়া গেছে।

গাছে ফুল আসার পর ফল ( ড্রাগন) হয়ে পাকতে সময় লাগে ২৫ থেকে ৩০ দিন। শীত মৌসুম ছাড়া বছরের ৮-৯ মাস ড্রাগনের ফলন ভালো হয়। একটি গাছ সর্বোচ্চ ২০-২৫ বছর ফল দিতে পারে।

ড্রাগন বাগানে কথা হয় অরণ্যের পরিচালক শিরিন রহমানের সঙ্গে। শখের বাগানের লক্ষ্য উদ্দেশ্য তুলে ধরে শিবির বলেন, সাত দিন পরপর গাছ থেকে ড্রাগন কাটা হয়। সব মানুষ যেন ড্রাগন খেতে পারেন-এজন্য অরণ্যের ড্রাগনের দাম কম রাখা হয়। পাশাপাশি অরণ্য দেখে শিক্ষিত ও বেকার তরুণ যুবকেরা ড্রাগন চাষে উৎসাহিত হচ্ছে।

চাকরির পেছনে না ছুটে তরুণ-যুবকেরা ড্রাগন চাষ করে সহজে বছরে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আয় করতে পারেন জানিয়ে শিবির রহমান বলেন, তখন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে কক্সবাজারে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ ড্রাগন চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা সম্ভব।

দেখা গেছে, শহরের ব্যসায়ীরা অরণ্যে গিয়ে পাইকারীতে প্রতিকেজি ২৫০ টাকায় ড্রাগন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। খুঁচরা বাজারে এই ড্রাগন বিক্রি হয় ৩৫০-৩৭০ টাকায়।

ফল ব্যবসায়ী আবদুস সালাম বলেন, অরণ্যের ড্রাগন আকারে বড় ও ভেতরে লাল, স্বদেও অনেক মিষ্টি। তাই বেশিরভাগ মানুষ অরণ্যের ড্রাগন কিনতে চান।

কক্সবাজার শহর ছাড়াও রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়া, উখিয়া, টেকনাফের বাজারেও অরণ্যের লাল ড্রাগন বেচবিক্রি হচ্ছে।

বকুল হোসেন বলেন, গত বছর অরণ্যে উৎপাদিত ড্রাগন বিক্রি হয়েছিল ২ লাখ টাকা। এবার পাঁচ লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি হয়েছে। গাছে ঝুঁলছে আরও কয়েক লাখ টাকার ড্রাগন।

অরণ্যের মালিক লুৎফর রহমান কাজল বলেন, শখের বসে বাগানটি তিনি গড়ে তুলেছেন অবসর যাপনের জন্য। শহুরে জীবন ছেড়ে মাঝেমধ্যে পরিবার নিয়ে তিনি অরণ্যে এসে সময় কাটান। বাগানের এক পাশে তৈরি করা হলো অত্যাধুনিক বাংলোবাড়িও।

তিন বছর লোকসান গুনতে হয়েছে জানিয়ে লুৎফর রহমান কাজল বলেন, তবে এ বছর থেকে লাভের মুখ দেখছে অরণ্য। শহরজুড়ে অরণ্যের লাল ড্রাগন বিক্রি হচ্ছে দেখলে মনে আনন্দ জাগে। কম দামে ভোক্তাদের ড্রাগন সরবরাহ দিতে আগামীতে ড্রাগনচাষ আরও বিস্তৃতির প্রস্তুতি চলছে।

পরীক্ষামুলক কফি চাষ

অরণ্যের এক পাশে চলছে কফি চাষ। গাছ লাগানো হয় ২৫০টি। কিছু গাছে ফল ধরেছে। ফল (দানা) থেকে কফি উৎপাদন হবে। লুৎফর রহমান বলেন, বাগানে পরীক্ষামুলকভাবে কফির চাষ হচ্ছে। কক্সবাজার ভ্রমণে আসা দেশিবিদেশি পযটকের কফির প্রতি আকর্ষণ বেশি। কফির উৎপাদন ভালো হলে চাষও বাড়ানো হবে।

অরণ্য ঘুরে দেখা গেছে, ড্রাগনের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের আম, মাল্টা, লিচু, সৌদি খেজুর, আঙ্গুর, রামবোটাম, মিষ্টি জলপাই,মিষ্টি তেতুল, পেপে, বরই, পেয়ারা, সুইট লেমন, বিভিন্ন জাতের লেবু, কাজু বাদামের চাষ হচ্ছে। প্রতিটি গাছে মাল্টা ধরেছে ৫০-৬০টি করে। বাগানে মাল্টা গাছ আছে ১৬০টি।

অরণ্যের একপাশে ৪০ শতক আয়তনের একটি পুকুর। তাতে রুই, কাতাল, সিলভার আবিয়া দৌড়ঝাপ মনকে উৎফুল্ল করে।

সূত্র : আব্দুল কুদ্দুস রানা, প্রথম আলো

সারাদেশ-এর আরও খবর