বঙ্গের বন্ধু ফিরেছিলেন বাংলায়

আবদুল মান্নান

  বিশেষ প্রতিনিধি    10-01-2023    172
বঙ্গের বন্ধু ফিরেছিলেন বাংলায়

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পড়ন্ত বিকেলে ঢাকায় মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান জেনারেল নিয়াজি প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা তো মূল্যহীন মনে করছেন তখন অনেকেই। কখন তাঁকে মুক্ত করা হবে, আদৌ হবে কিনা তাও জানা সম্ভব ছিল না। ঘণ্টা যায় দিন যায় কোনও ভালো খবর আসে না। কিছু অতি উৎসাহী মুক্তিযোদ্ধা আবেগে বলে বসেন, জাতির পিতাকে মুক্ত করতে প্রয়োজনে তারা পশ্চিম পাকিস্তানে অভিযান চালাবেন। এমন এক অনিশ্চিত সকালে ৮ জানুয়ারি বিবিসি লন্ডন খবর দিলো পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু এখন লন্ডনে। ত্বরিত সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লো কোটি বাঙালির ঘরে ঘরে। পিতা এখন মুক্ত। অচিরেই তিনি প্রত্যাবর্তন করবেন স্বদেশে। পরের খবর, স্বাধীনতার মহানায়ক দিল্লি হয়ে ঢাকা ফিরবেন ১০ জানুয়ারি।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, সোমবার। দুদিন ধরে পাকিস্তানের দখলদারমুক্ত নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন একজন মানুষের দেশে ফেরার জন্য, যিনি বাংলার বন্ধু, জনগণের বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের তেইশ বছরের শাসনামলে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। পাকিস্তানের শাসনামলের তেইশ বছরের তের বছর তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন, দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁর একমাত্র অপরাধ, তিনি আজীবন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে যে আচরণ করেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, পাকিস্তানের সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গোড়ার ইতিহাসে ফিরে গেলে এটা তো এখন পরিষ্কার, পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উত্তর ভারত, পাঞ্জাব ও বিহারের এলিট শ্রেণি ও সেখানকার ভূস্বামীদের স্বার্থ রক্ষা করা। ভারতের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা হয়ে উঠেছিল গৌণ। যত সংখ্যক মুসলমান নিয়ে পাকিস্তান যাত্রা শুরু করেছিল, তার চেয়ে বেশি মুসলমান তো ভারতে রয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের তেইশ বছরের শোষণ শাসনের শেষ পরিণতি বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত বাঙালি নিধনের এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়ি থেকে পাকিস্তান সেনা বাহিনী অত্যন্ত অমর্যাদাকরভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। একদিন পর তাঁকে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি হয়ে পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি কারাগারে কারারুদ্ধ করে তাঁর বিরুদ্ধে বারোটি অভিযোগ উত্থাপন করে, যার একটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। রাষ্ট্রদ্রোহিতার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। নয় মাসে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। সব শেষে তাঁর বিচার শুরু হয়েছিল আগস্ট মাসে মিয়ানওয়ালি কারাগারে। ১৯৭১ সালের ১৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিদেশি সাংবাদিককে বলেছিলেন, তিনি শুরুতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রখ্যাত আইনজীবী এ কে ব্রোহি তাঁর পক্ষে আদালতে আইনি লড়াই করুক। কয়েক কার্যদিবস শেষে বঙ্গবন্ধুর কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল বিচারের নামে যা চলছে তা স্রেফ প্রতারণা। আসল উদ্দেশ্য তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানো। তিনি তাঁর নির্বাচিত আইনজীবীকে নিষেধ করেছিলেন বিচার নামক এই তামাশার অংশীদার হতে।

ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। কথিত বিচারকার্যও প্রায় শেষ, ঠিক তখনই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলো। যদিও পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি, কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধে শুধু যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা-ই নয়, পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে তখন পশ্চিম পাকিস্তানও সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। একদিকে তাদের শোষণের বড় ক্ষেত্র পূর্ব বাংলা হাতছাড়া হয়ে গেলো, অন্যদিকে পশ্চিম অংশও যায় যায় অবস্থা। পাকিস্তানের অনেক বড় বড় শহরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। করাচি বন্দর ভারতীয় বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই সময় সেই অংশ রক্ষা করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে রয়েছে আন্তর্জাতিক চাপ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর অবশিষ্ট পাকিস্তানব্যাপী তীব্র গণ-অসন্তোষের মুখে ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করে পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

ভুট্টো এটি ঠিক আঁচ করতে পেরেছিলেন জিন্নাহর পাকিস্তানের এখন আর অস্তিত্ব নেই। তিনি পুরোনো পাকিস্তানের একটি অংশের মাত্র প্রেসিডেন্ট। ভুট্টো শেষ চেষ্টা করতে চান জিন্নাহর পাকিস্তানকে রক্ষা করতে। বঙ্গবন্ধুকে কারাগার হতে আনা হলো রাওয়ালপিন্ডির কাছে একটি রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায়। ভুট্টো এলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু তখনও সঠিক জানেন না সার্বিক পরিস্থিতি। তবে ভুট্টোর কথায় তিনি বুঝে গেলেন বাংলাদেশ স্বাধীন, আর ভুট্টো একটি খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। ভুট্টো অনেকটা অনুনয় করে বঙ্গবন্ধুর কাছে অনুরোধ করলেন তিনি যেন পাকিস্তানের সঙ্গে একটি যোগসূত্র রাখেন। বঙ্গবন্ধু জনমানুষের নেতা। তিনি তাঁর জনগণের সঙ্গে আগে কথা বলতে চান জানিয়ে দিলেন ভুট্টোকে। ভুট্টোর অসহায়ত্ব ঠিকই বুঝে গিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ভুট্টো সত্তরের নির্বাচনের পর ইয়াহিয়ার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে তিনি আজ নিজেই তার সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। এটাই তখন তাঁর নিয়তি। বঙ্গবন্ধুকে তিনি পিআইএ’র এক বিশেষ বিমানে জানুয়ারির ৮ তারিখ লন্ডনে পাঠিয়ে দিলেন। তখন দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ও বাংলাদেশ সরকারের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ছিলেন কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী। তাঁরা ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন, যার অন্যতম ছিল ভারত থেকে এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর দেশে ফেরা। প্রয়াত কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের বালুকাবেলায়’ লিখেছেন, ‘অকস্মাৎ আলোচনা কক্ষের দরজাটা সশব্দে খুললেন মানি দীক্ষিত (জে এন দীক্ষিত, ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, পরবর্তীকালে নিরাপত্তা উপদেষ্টা)। অনেকটা উত্তেজিত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘এই মাত্র খবর এসেছে শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন, ভেঙে গেলো বৈঠক, সম্মেলন কক্ষটি ভেঙে পড়লো স্বতঃস্ফূর্ত করতালিতে’।

৮ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি লন্ডন পৌঁছালো। তাঁকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানালেন লন্ডনে অবস্থানরত বাঙালি কূটনীতিবিদ রেজাউল করিম ও মহিউদ্দিন আহম্মদ। তারা দেখলেন দীর্ঘ কারাবাসের কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। আসলে তাঁর ওজন তখন প্রায় চল্লিশ পাউন্ড কমে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু উঠলেন লন্ডনের অভিজাত হোটেল ক্লারিজেসে। ক্লান্ত বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন ছিল বিশ্রাম, কিন্তু ততক্ষণে খবর রটে গিয়েছে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা লন্ডনে। তাঁকে একনজর দেখার জন্য হোটেলের পাশের রাস্তায় লেগে গেলো ভিড়। তাঁর হোটেল কক্ষে হুমড়ি খেয়ে পড়লো বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু অবহিত হয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ আর প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব সম্পর্কে। কথা বলে নিয়েছেন কয়েকজন নেতৃবৃন্দের সাথেও। বঙ্গবন্ধু ততক্ষণে অন্য উচ্চতায়। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ঠিক যেমন একজন রাষ্ট্রনায়কের দেওয়া উচিত। বিশ্বের মানুষ অন্য আরেক বঙ্গবন্ধুকে চিনলো, শুনলো, জানলো।

পরদিন ৯ জানুয়ারি। লন্ডন সময় রাত ৮টা। বাংলাদেশে তখন রাত দুইটা। ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া একটি বিশেষ কমেট বিমানে জাতির পিতা লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের পথে রওনা হলেন। বিমানবন্দরে স্বাধীন দেশের স্থপতিকে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে বিদায় জানাতে এসেছিলেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার আপা পন্থ। লন্ডন ত্যাগের আগে তিনি দেখা করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। হিথ তখন অন্য শহরে ছুটি কাটাচ্ছেন । তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু দেখা করতে চান শুনে তিনি ছুটি বাতিল করে ছুটে আসেন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে। গাড়ির দরজা খুলে নিজে রিসিভ করেন বাঙালির মহানায়ককে। সেই রাতে বাংলাদেশের অনেক মানুষ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। অনেকে নফল নামাজ পড়েছেন, রোজা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটির প্রথম গন্তব্য ভারতের রাজধানী দিল্লি। মাঝপথে জ্বালানি নেওয়ার জন্য কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি সাইপ্রাসের নিকোশিয়া ও বাহরাইনে। লন্ডন ছাড়ার আগে ভারতের হাইকমিশনার টেলিফোনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ত্রিশ মিনিট ধরে চললো সেই আবেগঘন আলোচনা।

১০ জানুয়ারি সকাল আটটায় বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করলো। দিল্লিতে জানুয়ারি মাসে শীতের প্রকোপটা তীব্র। সব প্রটোকল ভেঙে পালাম বিমানবন্দরে তখন উপস্থিত ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আছেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ। বঙ্গবন্ধু আভিধানিক অর্থে তখন মাত্র একজন নির্বাচিত শপথ না নেওয়া সংসদ সদস্য, একজন সিভিলিয়ান। দিল্লি বিমানবন্দরে এই সময় ঘটলো এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী তখন সন্তানসম্ভবা। হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বায়না ধরলেন তিনি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটার সাক্ষী হয়ে থাকতে চান। বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সে সোনিয়াকেও বিমানবন্দরে আনা হলো। দেখলেন তিনি তাঁর জীবনের প্রথম একজন মহানায়ককে। এর দুদিন পর প্রিয়াঙ্কার জন্ম হয়। একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে যেসব প্রটোকল দেওয়া হয় ঠিক একই প্রটোকল দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানো হয় বিমানবন্দরে। ফারুক চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘(সকাল) আটটা বেজে দশ মিনিট। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া রুপালি কমেট বিমান। ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগলো। খুলে গেলো দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্যে, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের দুটি শব্দ। “জয় বাংলা”। তখন দিল্লির সব ধরনের ভিভিআইপি আর সাংবাদিকদের ভিড়ে পালাম বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মীদের অবস্থা কাহিল। বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন ভারতের রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সম্মানে দাগা হলো কামান একুশবার। তারপর একটি চৌকস সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার। দিল্লিতে প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর ব্রাস ব্যান্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজানো হলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

বিমান থেকে নামার পর সব প্রটোকল শেষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের সেনানিবাসের ময়দানে। সেখানে তিনি সেই শীতের সকালে উপস্থিত কয়েক হাজার জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন। কিছুটা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য। তবে বাদ গেলো না কোনও প্রসঙ্গ। ভারত সরকারের সাহায্য আর ভারতের আপামর গণমানুষের সহায়তা আর ত্যাগের কথা। বাংলার বন্ধু মাঝে মাঝে আবেগপ্রবণ, কখনও অশ্রুসিক্ত। কথা ছিল তিনি ইংরেজিতে ভাষণ দিবেন। কিন্তু অনেকটা জনগণের দাবিতে তিনি বললেন বাংলায়। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় অনুরোধ করেছেন বঙ্গবন্ধু যেন যাত্রাপথে কলকাতা হয়ে যান। বিনয়ের সঙ্গে তিনি জানালেন যাওয়ার পথে কেন? যেই রাজ্যের মানুষ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের পৃথকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে তিনি অতিসত্বর কলকাতা আসবেন। আর তিনি এও জানতেন তাঁকে বরণ করে নেওয়ার জন্য নিজের দেশে কোটি মানুষ অপেক্ষা করছেন। শীতের দিনের বেলা তাড়াতাড়ি ফুরায়। পাঁচটায় সন্ধ্যা নামে। আলো থাকতে তাঁকে ঢাকায় ফিরতে হবে।

ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধু ঢাকা পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিমান ‘রাজহংসে’ ভ্রমণ করবেন, আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিমানটি দিল্লি থেকে লন্ডনে ফিরবে। এরই মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিমান থেকে সব মালপত্র ‘রাজহংসে’ তোলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এই সময় জানিয়ে দিলেন, তিনি ভারত সরকারের প্রতি বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করার জন্য কৃতজ্ঞ, তবে যাত্রার মাঝপথে ব্রিটিশ বিমান ছেড়ে দেওয়াটা অসৌজন্যমূলক হবে। সুতরাং বাকি পথটাও তিনি একই বিমানে যাবেন। আবার মালপত্র স্থানান্তর হলো। বঙ্গবন্ধুর বিদেশ নীতির গোড়াপত্তন বলা যেতে পারে। দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুর যাত্রাসঙ্গী হয়েছিলেন ফারুক চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের সেই প্রসন্ন অপরাহ্নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে অনুধাবন করেছিলাম যে আমাদের নবীন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে কূটনীতি আর কূটনৈতিক আচরণে দীক্ষালাভের আমার রয়েছে যথেষ্ট অবকাশ’।

দুপুরের কিছু পর বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ব্রিটিশ বিমান দিল্লি ছাড়লো। তখন শুধু ঢাকা বিমানবন্দর বা রমনা রেসকোর্স নয়, মনে হচ্ছিল ঢাকা শহরের কোনও মানুষ ঘরে নেই। সকলে রাস্তায়। সকলে দেখতে চায় ইতিহাসের বরপুত্রকে। পড়ন্ত বিকালে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করলো। বিমানের দরজা খুললো। দরজায় এসে দাঁড়ালেন ইতিহাসের সেই বরপুত্র শেখ মুজিব, যার জন্য দেশের কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন প্রবাসী সরকারের নেতৃবৃন্দ। দেওয়া হলো নতুন দেশের চৌকস নতুন সেনাবাহিনীর গার্ড অব অনার। বাজলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। উঠানো হলো একটি খোলা ট্রাকে। জনগণের নেতাকে জনগণ দেখতে চায়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। নিয়ে যাওয়া হলো রমনা রেসকোর্সে, যেখানে লক্ষ জনতা তাদের মহানায়কের জন্য অপেক্ষা করছেন। এই যেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পুনরাবৃত্তি।

কী হতো বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা হত্যা করলে? তিনি যদি কারাগার থেকে মুক্ত না হতেন? একান্ন বছর পর চিন্তা করলে উত্তরে তেমন ভালো একটা কিছু পাওয়া কঠিন। প্রবাসী সরকার গঠন করার সময় কারা সরকার গঠন করবে তা নিয়ে কিছু টেনশন তো ছিলই। একদিকে আওয়ামী লীগের ভিতর একটি মহল চেয়েছিল বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে একটি সরকার গঠন করা হোক। সেনাবাহিনীর একাংশ চেয়েছিল তাদের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল হোক। এমনটি হলে বিশ্ব মনে করতো এটি কোনও স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, এটা একটি সেনা বিদ্রোহ। এই দুটোর কোনোটা হলে ভারতের সহায়তা পাওয়া কঠিন বা অসম্ভব হতো। শুধু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দিয়ে সরকার গঠন করাই সর্বোত্তম বিকল্প। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্

মুক্তমত-এর আরও খবর