দুর্নীতি দমনে পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতা চায় দুদক

  বিশেষ প্রতিনিধি    25-04-2023    113
দুর্নীতি দমনে পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতা চায় দুদক

দুর্নীতি দমনে পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতায় চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একইসঙ্গে অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতেও কার্যক্রম হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকারের এই সংস্থাটি। এসবের মধ্যে রয়েছে সার্ভিলেন্স, কমিউনিকেশন্স ইন্টারসেপশন ও আন্ডারকভার অপারেশন পরিচালনার নীতিমালা তৈরি করে বিশেষায়িত লোকবল নিয়োগের বিষয়। প্রো-অ্যাকটিভ অনুসন্ধানের উদ্যোগের বিষয়টিও রয়েছে পরিকল্পনায়।

দুদক কর্মকর্তারা জানান, বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থসম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে— সংশ্লিষ্ট দেশে আইনি সহায়তা। এজন্য প্রাথমিকভাবে তথ্য ও ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ এবং পরবর্তী সময়ে সমস্যা মিউচুয়্যাল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স রিকোয়েস্টের (এমএলএআর )মাধ্যমে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়। এ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করার জন্য দুদক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ডেডিকেটেড জনবল গড়ে ওঠেনি। একইসঙ্গে অর্থ-সম্পদ পাচার সংক্রান্ত তদন্ত পরিচালনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যথেষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সেজন্য দুর্নীতি দমন কমিশন এবং এর কর্মকর্তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানের কোনও বিকল্প নাই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২০ মার্চ রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে এলক্ষ্যে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অর্থ-সম্পদ পাচার রোধ এবং পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে দুদককে অগ্রণী ভূমিকায় দেখতে চাইলে দুদককে পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতা দিতে হবে। একইসঙ্গে বিদেশ থেকে তথ্য ও ইন্টেলিজেন্স প্রাপ্তি সহজ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের দুর্নীতি দমন সংস্থার সঙ্গে একই উদ্দেশ্যে সমঝোতা স্মারক সই এবং সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তি সইয়ের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে হবে। বিদেশ থেকে সম্পদ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বেগবান করতে হলে দুদক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ডেডিকেটেড জনবল নিয়োগ করে তাদেরকে দেশে-বিদেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক আইন বিষয়েও কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে দুদকের পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে রয়েছে— ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) এবং এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অব মানিলন্ডারিং (এপিজি) সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা ও মিউচুয়্যাল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্ট রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানোর বিষয়টি। এছাড়া বিদেশি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় এবং ন্যাশনাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজের জন্য মানিলন্ডারিং অনুবিভাগে পৃথক ডেস্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায় দুদক।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি ও ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, জাতীয় কৌশলপত্রের অ্যাকশন আইটেমগুলো বাস্তবায়ন, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সঙ্গে সমন্বয় ও দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মানিলন্ডারিং অনুবিভাগে পৃথক ডেস্ক স্থাপন করবে দুদক।

বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার হয়ে থাকে, এমন দেশের সঙ্গে সাক্ষ্য প্রমাণ আদান-প্রদান, সম্পদ পুনরুদ্ধার, ফ্রিজ, ক্রোক ও বাজেয়াপ্তকরণ কার্যকর করার জন্য দ্বিপাক্ষিক আইনি সহযোগিতা চুক্তি মিউচুয়্যাল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স ট্রিটলি (এমএলএটি) করা। মানিলন্ডারিং এবং ব্যাংক ও বিমা সংশ্লিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত, ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং, ডিজিটাল ফরেনসিক, সার্ভিলেন্স ও আন্ডারকভার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও স্টাডি ট্যুরের আয়োজন করারও পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির।

বাংলাদেশ থেকে সচরাচর যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়ে থাকে, সেসব দেশের দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর সঙ্গে তথ্য ও ইন্টেলিজেন্স আদান-প্রদানের লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক সইয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেবে। ইতোমধ্যে তিনটি দেশের দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে পাঠানো এমএলএআর ’র সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনা ও ব্যবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে দুদক, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সমন্বয় সভা করা ছাড়াও দুর্নীতি প্রতিরোধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে যোগদানের পরিকল্পনাও রয়েছে দুদকের।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সদস্য পদ পেতে হলে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আবেদন করতে হবে। ইউএনওডিসির সরবরাহ করা একটি নমুনা অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম পূরণ করে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের মাধ্যমে আবেদন করলে এর সদস্যপদ পাওয়া যাবে।

দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। হয়তো একটু সময় লাগবে।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করতে গিয়ে আমাদের অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সদস্য হতে পারলে— আমরা সরাসরি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবো। এতে দ্রুত পাচারবিষয়ক মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা সহজ হবে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে দুদক।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানিলন্ডারিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে আইনি ক্ষমতা চেয়ে দুদকের পক্ষ থেকে দেওয়া এ প্রস্তাবনাগুলোকে আমি সমর্থন করি। তবে এটাই শেষ কথা নয়। দুদকের এখতিয়ার যদি বাড়ানো হয় তাহলে প্রশ্ন আসবে যে, এসব পদক্ষেপ নেওয়ার দক্ষতা দুদকের আছে কিনা। সেটা আগে বিবেচনা করতে হবে দুদককে। সেই সঙ্গে দুদকের একার পক্ষে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বা পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং অপরাধীকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়। শুধু দুদক নয় কোনও সংস্থার পক্ষেই এটা সম্ভব নয়। সেজন্য দুদকের পাশাপাশি পুলিশের হাতে অর্পিত যেসব ক্ষমতা আছে যেমন- সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মধ্যে সমন্বয় দরকার। সম্মিলিত উদ্যোগের দরকার। এটা আমরা কখনও দেখিনি।’

দুদকের দক্ষতা বাড়াতে টিআইবির সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক আছে জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা দুদকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সহযোগিতা করে থাকি। আশা করি, এটা অব্যাহত থাকবে। এর আগে আমরা তাদের অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আমরা কাজ করেছি, সহযোগিতা করেছি। সেটা অব্যাহত ছিল এবং থাকবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সাম্প্রতিককালে এটা অবশ্য একটু ভাটা পড়েছে। যদিও আমাদের সঙ্গে এখনও সমঝোতা স্মারকটি অব্যাহত আছে।’

অর্থ-বাণিজ্য-এর আরও খবর