আন্দোলন-নির্বাচন নয়, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে জাতীয় পার্টি

  বিশেষ প্রতিনিধি    04-08-2023    106
আন্দোলন-নির্বাচন নয়, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে জাতীয় পার্টি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতির মাঠ। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। অপরদিকে আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অনড়। পাশাপাশি রাজপথে বিরোধীদলকে কোনো ধরনের ছাড় দিতে অপারগ। বড় দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। বিরোধীদলের ওপর পুলিশের অবস্থানও কঠোর। আবার বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দেশের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো।

এই যখন পরিস্থিতি, তখন অনেকটা ‘রিলাক্স মুডেই’ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি। দলটি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনগুলোতে অংশ নিচ্ছে, আবার অনিয়মের অভিযোগও তুলছে।

চলতি বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সে হিসাবে নির্বাচনের বাকি আর ৫-৬ মাস। নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও আগামী নির্বাচনে জাপার ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে স্পষ্ট জবাব নেই দলটির নীতি-নির্ধারকদের কাছে।

জাপার শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেও জাপা তা চায় না। কেননা বিগত দিনগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া কোনো দল লাভবান হয়নি। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ের উপ-নির্বাচনে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রমাণ করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তাই নতুন ফর্মুলায় আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চান তারা। তবে দলটির কেউ কেউ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে এরই মধ্যে জনসংযোগ শুরু করেছেন।

দলটির একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সমালোচনা করছেন শীর্ষ নেতারা। ফলে ‘গৃহপালিত দল’ এর তকমা মুছে স্বতন্ত্র দল হিসেবে মানুষের কাছে জাতীয় পার্টির গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। জাতীয় পার্টি নিয়ে নতুন আশা ও নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে, যা সরকারের ভয়ের কারণ। এ কারণেই গত বছর জাতীয় পার্টিকে ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকার জাতীয় পার্টিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। যার একটি উদাহরণ, গত ১০ জুন অনুষ্ঠানের জন্য জাতীয় পার্টির পূর্বনির্ধারিত ভেন্যু থেকে সরিয়ে জামায়াতকে দেওয়ার ঘটনা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির অতিরিক্ত মহাসচিব অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুই মাস আগে জাতীয় পার্টির একটা অনুষ্ঠানের জন্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) মিলনায়তন বুকিং দিয়েছিলাম। জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন যুব সংহতির কেন্দ্রীয় সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। সেখানে আমাদের চেয়ারম্যানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম যে আগের দিন রাতে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলো জামায়াত ইসলামকে সেটা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমাদের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ওনারাই (পুলিশ) ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা বৃহত্তর সমঝোতার স্বার্থে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে জিনিসটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু সেটা আমাদের জন্য অড (খারাপ) হয়েছে।’

সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকলেও আন্দোলনে না থাকার কারণ হিসেবে দলটির নেতারা সাংগঠনিক দুর্বলতা ও বিএনপির আধিপত্যের কথা বলছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক নেতা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ও উপ-নির্বাচনে প্রার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় সরকার চাপে রয়েছে। সরকারের জনসমর্থনও কমেছে। একদিকে সরকার জাতীয় পার্টির সমর্থন চায়, অন্যদিকে দলকে ভাঙতে চায়। উপ-নির্বাচনে জাপার প্রার্থীদের বের করে দেওয়া হয়। এভাবে হয় না। অন্যদিকে বিএনপি নানান সময়ে জাতীয় পার্টির ক্ষতি করেছে।’

বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেও জাপা তা চায় না। কেননা বিগত দিনগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া কোনো দল লাভবান হয়নি।

এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। সেটা কীভাবে হবে তা সম্মেলন ও সভাগুলোতে আমাদের চেয়ারম্যান, মহাসচিব বলেছেন। বিরোধীদল যেভাবে আন্দোলন করছে, আমরা সেই ক্যাটাগরিতে যাচ্ছি না। কিন্তু দল কী চাচ্ছে সেটা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলছি। জাতীয় পার্টি একেবারে মাঠে নেই, এটা ঠিক নয়। আমাদের নানান কর্মসূচি চলছে। যার যার দাবি আদায়ে দলগুলো রাজপথে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতে যেন কারও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি না হয়, সেটা আমরা কামনা করি।’

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘আমরা রাস্তায় নামছি না, কারণ বর্তমান সরকার বিরোধী কণ্ঠ বন্ধ করার জন্য হেন কোনো কাজ নেই করে না। বর্তমান সরকারের দমননীতিতে টিকে থাকা স্বাভাবিক কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি তাদের (বিরোধীদলের) সেই রকম শক্তি না থাকে ও স্বাধীনভাবে অগ্রসর না হতে পারে। সেরকম অর্থ না থাকে, লোকবল না থাকে তাহলে তারা মাঠে টিকতে পারবে না।

জাপা চেয়ারম্যান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাপাকে বিভিন্নভাবে দুর্বল করা হয়েছে এবং জাপাকে দুর্বল করতে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার জন্য সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছি। এরপর থেকে দলটি জাতীয় পার্টিকে সবচেয়ে বেশি বিভক্ত করার চেষ্টা করেছে। ২০১৪ সালের পর থেকে বিভিন্নভাবে জাতীয় পার্টির ভেতরে একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে দলটির স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত করার চেষ্টা করেছে। জাতীয় পার্টির রাজনীতি স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যেতে পারেনি। বার বার হোঁচট খেয়েছে। ফলে জাতীয় পার্টি সত্যিকার অর্থে দুর্বল হয়ে গেছে।’

নতুন ফর্মুলায় নির্বাচন চায় জাপা

দলীয় সরকারের অধীনে কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারা। সে কারণে নতুন ফর্মুলায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন চান তারা।

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আমরা ফর্মুলা দিতে পারি। দরকার হলে সব দলের কাছ থেকে ফর্মুলা নিয়ে বসে ঠিক করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে জিএম কাদের বলেন, ‘সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার আন্দোলন আগেও হয়েছে। ১৯৯১ সালে আন্দোলনে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ছিল জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে। সেসময় সংবিধান অনুযায়ী বৈধ সরকার ছিল জাতীয় পার্টির সরকার। ওই দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনা হয়েছিল, সেটা কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সংবিধান বুঝি না, তত্ত্বাবধায়কও বুঝি না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আমরা ফর্মুলা দিতে পারি। দরকার হলে সব দলের কাছ থেকে ফর্মুলা নিয়ে বসে ঠিক করা যেতে পারে।’

এ বিষয়ে জাপার অতিরিক্ত মহাসচিব অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা খুব কম। এ কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই না, এটা শুরু থেকেই বলে আসছি। ’৯১ সালে যে দলনিরপেক্ষ সরকার গঠিত হয়েছিল, তখন তিন জোটের রূপরেখায় বলা হয়েছিল, সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে সমান সুযোগে পাবে। কিন্তু আমরা দেখেছি, ’৯১ সালে জাপাকে সমান সুযোগ দেওয়া হয়নি। ওই দলনিরপেক্ষ সরকার প্রথমেই একটা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। প্রথম থেকেই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি।’

তিনি বলেন, সুষ্ঠু ভোট করতে নির্বাচনী ফর্মুলা আমরা দিয়েছি। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের কথা বলেছি। আমরা বিশ্বাস করি, এর মাধ্যমে সুষ্ঠু ভোট হতে পারে। প্রতীকে ভোট হবে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই দল থেকে তত শতাংশ সংসদ সদস্য হবে। এটার বিস্তারিত ফর্মুলা আমরা উপস্থাপন করেছি। আমাদের চেয়ারম্যান বলেছেন, সর্বদলীয়ভাবে সংলাপের আয়োজন করে যে ফর্মুলা ভালো হবে, সেই ফর্মুলায় ভোট করার জন্য। সার্বিকভাবে আমরা দলীয় সরকারের অধীনে ভোট চাই না, আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারও চাই না। কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্কের বাইরে নেই।

জাতীয়-এর আরও খবর