কোন পথে যাবে বিএনপির আন্দোলন?

  বিশেষ প্রতিনিধি    03-06-2023    103
কোন পথে যাবে বিএনপির আন্দোলন?

আন্দোলনের ধরন বা প্রকৃতি কী হবে—এ নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে কোনও ইঙ্গিত এখনও স্পষ্ট হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির চলমান কর্মসূচি অব্যাহত থাকলেও আগামী তিন মাস টানা রাজপথে থাকার চিন্তাভাবনা চলছে। এ ক্ষেত্রে দাবি মানাতে গিয়ে সহিংসতাকে উদ্বুদ্ধ করে—এমন কর্মসূচি দেওয়া হবে কি হবে না, এ নিয়ে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের মধ্যে টানাপোড়েন আছে।

বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল ও যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির আসন্ন সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন কোন পথে যাবে, তা নির্ভর করছে দলটির নীতিনির্ধারকদের ওপর। পরিস্থিতি ২০১৪ সালের মতো সহিংস হবে নাকি ২০১৮ সালের মতো শান্ত-স্বাভাবিক থাকবে, এ নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত নেতারা বলছেন, আন্দোলন কোন দিকে যাবে— তা নির্ভর করছে জাতির সামনে বিএনপি কী প্রতিশ্রুতি দেয়। এখন পর্যন্ত যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত হয়নি। বিএনপির পক্ষ থেকে ৩১ দফার একটি প্রস্তাবনা তৈরি করলেও গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে সেটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির প্রভাবশালী একজন দায়িত্বশীল জানান, ১০ বা ১১ জুন চট্টগ্রাম, ১৭ জুন বগুড়া (রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ মিলে), ৭ জুলাই খুলনা, ১৫ জুলাই বরিশাল, ২২ জুলাই সিলেট এবং ২৯ জুলাই ঢাকায় ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ করবে দলটি। ইতোমধ্যে পাঁচ প্রকারের কর্মসূচি—বিক্ষোভ সমাবেশ, প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রা, অবস্থান কর্মসূচিগুলো শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা হয়েছে।

এই দায়িত্বশীলের ভাষ্য, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির দিকে বিএনপি সবার আগে পা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি নতুন করে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাবে কিছুটা বাধ্যবাধকতাও সৃষ্টি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে দলের মধ্যে সবাই-ই এখন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির পক্ষে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কর্মসূচি পালন করে আমরা এতটুকু পথ এসেছি শান্তিপূর্ণভাবে; আমাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকবে। আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের ১৭ জন নেতাকর্মী মারা গেছেন। হাজার-হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে, মামলা দিয়েছে। আমরা কিন্তু শান্তিপূর্ণ রয়েছি। প্রত্যেক দিন সরকার মামলা দিচ্ছে; বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে নেতাকর্মীদের আন্দোলনের পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। তারপরও আমরা অহিংস উপায়ে আন্দোলনে রয়েছি।’

যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা সহিংসতায় বিশ্বাস করি না। গত দুই বছর ধরে আমরা সরকারের নানা রকম উসকানি এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করে চলেছি। মানুষের মধ্যে এই কর্মসূচি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এখন নতুন করে যদি সহিংসতার দিকে সরকার ঠেলে দেয়, তাহলে এর সম্পূর্ণ দায় সরকারের।’

অতি সম্প্রতি বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে মঞ্চের নেতাদের সামনে ৩১ দফা সম্বলিত ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ শীর্ষক প্রস্তাবনা তুলে দেওয়া হয়। প্রতিক্রিয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন মঞ্চের নেতারা।

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা, বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ ও তারেক রহমান ঘোষিত ২৭ দফার আলোকে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। বিএনপির প্রস্তাবিত খসড়ায় গণতন্ত্র মঞ্চের প্রস্তাব থেকে কিছু বিষয় যুক্ত করা হলেও মঞ্চের নেতাদের আপত্তি রয়েছে আরও কিছু বিষয়ে।

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, খসড়া প্রস্তাবনায় বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রসঙ্গে কেবল কমিশন গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রেইনবো নেশন্স’ প্রতিষ্ঠা করার কথা উল্লেখ রয়েছে খসড়ার দুই নম্বর ধারায়।

মঞ্চের প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, ‘বিএনপি তাদের দলীয় চিন্তা-আদর্শ আমাদের ওপর চাপাতে চাইছে। আমরা এর বিরোধিতা করেছি। গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলো ছোট হলেও প্রত্যেকটি দলই জনস্বীকৃত। একই সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চ চাইছে প্রকৃত আন্দোলন গড়ে তুলতে। বিএনপি ক্ষমতায় এসে কী করবে, এ নিয়ে মঞ্চের আগ্রহ নেই।’

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করলেও বিএনপি নতুন প্রস্তাবিত খসড়ায় সংশোধন করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বিবেচনা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত এমন বিষয়কে বাদ রেখে অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ পাওয়ার কথা রয়েছে। মঞ্চের নেতারা বলছেন, তাহলে আর সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা থাকলো কোথায়? তাদের ভাষ্য, কেবল আস্থাভোট ও বাজেট ছাড়া বাকি বিষয়ে মতামত প্রদানের বিষয়টি থাকা উচিত।

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ করার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে বিএনপি উল্লেখ করেছে, বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে উচ্চ কক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। যদিও মঞ্চের নেতাদের দাবি, সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক হারে দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকবে উচ্চকক্ষে। মঞ্চের একজন নেতার মন্তব্য, আমরা চাই সক্রিয় উচ্চকক্ষ। এটাকে উপঢৌকন হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ নেই।

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলছেন, যৌথ ঘোষণাপত্র বিএনপির একক কিছু না। এটা হচ্ছে জনমানুষের সামনে পরিবর্তিত রাজনীতির ইশতেহার। তারা প্রকৃত অর্থে পরিবর্তন চায় কিনা, সেটিও বিবেচনা করতে হবে। একই সঙ্গে বিএনপি ক্ষমতায় এলে জাতীয় সরকার গঠন করবে, এই আগ্রহ নিয়ে যুগপতে যুক্ত হয়নি গণতন্ত্র মঞ্চ।

মঞ্চের আরেকজন নেতা বৃহস্পতিবার রাতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বিএনপির শীর্ষনেতৃত্বকে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা নিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির শীর্ষ পর্যায় ও ড্রাফটিং পর্যায়ের নেতারা তাকে সে পথে যেতে উৎসাহ যোগাচ্ছেন, বলেও দাবি করেন এই নেতা। গত ১৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিএনপি ও মঞ্চের লিয়াঁজো কমিটির বৈঠক এ প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক সাইফুল হক বৃহস্পতিবার বিকালে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যৌথ ঘোষণাপত্র নিয়ে এখনও কাজ করছি। এটা কোনও দলীয় ঘোষণা নয়। আমাদের আলোচনা অব্যাহত আছে। যৌথ ঘোষণাপত্রকে কেবল বিএনপি বা গণতন্ত্র মঞ্চের একক জায়গা থেকে বিবেচনা করার সুযোগ নেই।’

‘বিএনপি বা গণতন্ত্র মঞ্চের কারও উচিত হবে না দলীয় রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে অন্যদের সম্মতি আদায় করা’ উল্লেখ করেন সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘যৌথ ঘোষণাপত্র হবে পরিবর্তনের জাতীয় চার্টারের মতো। তাতে পরিবর্তনের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা ধারণ করাই এখন জাতীয় কর্তব্য। জাতীয় নেতৃত্বকে এখন পরিবর্তনের এই আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েই এগিয়ে যাওয়া দরকার।’

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যৌথ রূপরেখা নিয়ে কোনও জটিলতা নাই। যাদের জটিল করার উদ্দেশ্য আছে, তারা বলছে জটিলতা। আমরা ভালোভাবে আলোচনা এগিয়ে যাচ্ছি। এটা (রূপরেখার ঘোষণা) তো এই মুহূর্তে দরকার নাই। এটা কালকে সকালেই করতে হবে, তা নয়। যখন সময় হবে, আমরা এটাকে সামনে আনতে চাই।’

মঞ্চের আরেক প্রভাবশালী নেতা বলেন, ‘কোনোভাবে রূপরেখায় ঐক্যমত না হলে কেবলমাত্র সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নিরপেক্ষ বা নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিগুলোতেই ঐক্যমত আসবে। এ ক্ষেত্রে ন্যুনতম কোনও সংস্কার প্রস্তাবনা থাকতে হবে।

পদযাত্রা-রোডমার্চে সক্রিয় থাকবে মঞ্চ

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা মনে করছেন, বিএনপি অলআউট কোনও কর্মসূচিতে আপাতত যাচ্ছে না। চলতি জুন, আগামী জুলাই ও আগস্ট মাসে স্বাভাবিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সময় পার করতে চায় বিএনপি। এ ক্ষেত্রে গণতন্ত্র মঞ্চও টানা কর্মসূচিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মঞ্চের নেতা শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘যৌথ ঘোষণা যদি নাও আসে, তাহলেও আমরা আমাদের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবো। সেটার অংশ হিসেবে আমরা রোডমার্চ করছি। মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আগামী ৪-৭ জুন পর্যন্ত ঢাকা থেকে দিনাজপুর অভিমুখে রোডমার্চ করবে গণতন্ত্র মঞ্চ। এরপর আমরা ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনায়ও রোডমার্চ করবো। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হয়ে গেলে আমরা একদফার আন্দোলনে যাবো। দাবি না মানলে অনেক বড় কর্মসূচি আসতে পারে। আমরা দলীয় সরকারের অধীনে কোনও নির্বাচনে যাবো না।’

জাতীয়-এর আরও খবর