গাজার ভবিষ্যত্ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে মতভেদ

  বিশেষ প্রতিনিধি    18-12-2023    73
গাজার ভবিষ্যত্ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে মতভেদ

‘গাজা কি ২০২০ সালের মধ্যে বাসযোগ্য থাকবে’ ২০১২ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পরিদর্শন করে জাতিসংঘের কান্ট্রি টিম এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। গাজার বাসিন্দারা জল, স্থল ও আকাশ পথে সেই ২০০৭ সাল থেকেই অবরুদ্ধ জীবন কাটাচ্ছে। বহির্বিশ্ব থেকে তাদের কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে ইসরায়েল।

অবরুদ্ধ থাকার মধ্যেই গাজা সময় সময় ইসরায়েলি সামরিক হামলার শিকার হয়েছে। ২০১৪ সালে ইসরায়েল সেখানে চালায় অপারেশন প্রটেক্টিভ এজ (ওপিই)। ইসরায়েলের অভিযোগ, হামাস সেখান থেকে রকেট ছোড়ে। হামাসের রকেট ছোড়ার ক্ষমতা ধ্বংস করাই ছিল ঐ অভিযানের লক্ষ্য। এতে ২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও গাজার অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাস্তুচ্যুত হয় প্রায় ৫ লাখ মানুষ। অবরোধ অব্যাহত থাকায় উপত্যকার পুনর্নিমাণকাজ বেশিদূর এগোয়নি। লন্ডনে বসবাসরত ফিলিস্তিনি লেখক তারেক বাকোনি গাজা ঘুরে গিয়ে ‘হামাস কন্টেইন্ড’ নামে একটি বই লিখেছেন (বইটি প্রকাশ করেছে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস)। এই বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন হামাসের জন্য সেখানে সিমেন্ট ও স্টিলের মতো দুটো প্রয়োজনীয় নির্মাণ উপাদানের চালান সহজে আনা যায় না। ইসরায়েলের অভিযোগ, এগুলো অস্ত্র নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে। তিনি আরো লিখেছেন, দীর্ঘ মেয়াদে গাজা বসবাসের উপযোগী থাকবে না। ২০১৪ সালের ইসরায়েলের ঐ সামরিক হামলা স্পষ্টতই হামাসের শক্তি খর্ব করতে পারেনি। ২০২১ সালের মে মাসেও সপ্তাহ খানেকের জন্য এমন সামরিক অভিযান চালিয়েছিল ইসরাইল। ফলাফল আগের মতোই থাকে। হামাসের রকেট ছোড়া বন্ধ করতে পারেনি।

এ বছর ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েল সীমান্তের ১৫ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে যে ঝটিকা আক্রমণ করে সেটা অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞকেই অবাক করেছে। কারণ সীমান্তের এই দূরত্ব পার হতে তাদের সামরিক স্থাপনা অতিক্রম করেই যেতে হয়েছে। হামাসের যোদ্ধারা সেদেরত এবং ওফাকিমের মতো ইসরাইলের ছোট দুই শহরে ঢুকে পড়ে সেখানে রক্তপাত ঘটায়। এটা ছিল একদিকে দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা, অন্যদিকে তাদের ওপর যুগ যুগ ধরে করে আসা নিগ্রহের প্রতিশোধের একটি চেষ্টা।

এর জবাবে ইসরায়েল যেভাবে পালটা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই শক্তির ভারসাম্য ছিল না। ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গাজাকে পরিণত করেছে এক মৃত্যুপুরীতে। নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ২২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আহত হয়েছে ৫০ হাজারের ওপর। ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৭ হাজারের বেশি মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। নিখোঁজদের সংখ্যা যোগ করলে মৃতের সংখ্যা অবশ্যই অনেক বেশি হবে। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ। বলতে গেলে সবাই নিজেদের বাসস্থান হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন রাস্তায়, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, হাসপাতাল বা জাতিসংঘের অফিস হিসেবে চিহ্নিত ভবনগুলোতে। কিন্তু সেখানেও তারা নিরাপদ নয়। ইসরায়েলি বাহিনী যেন টার্গেট করেই নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করছে। অপরদিকে, ইসরায়েলি সৈন্য এবং হামাস যোদ্ধাদের হতাহতের সংখ্যার দিকে তাকালে বোঝা যায় হামাসের চেয়ে ইসরায়েলি সৈন্য বেশি সংখ্যায় নিহত হয়েছে। ট্যাংকসহ তাদের সাঁজোয়া যানও ধ্বংস হয়েছে প্রচুর সংখ্যায়। গাজা এক জনবহুল ভূখণ্ড ছিল। কিন্তু আজ সেখানে কোনো বিদ্যুত্, পানি বা খাবার নাই। গাজার একমাত্র বিদ্যুত্ উত্পাদনকেন্দ্রটি এখন পুরোপুরি বন্ধ অবস্থায়। এটি বোমা হামলায় বিধ্বস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয় বরং জ্বালানির অভাবে এটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। উপত্যকাটিতে ১৬ বছর ধরে বহাল অবরোধের সময় সেখানে জ্বালানি পৌঁছেছে, যদিও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু এখন জ্বালানি সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ। পানি, বিদ্যুত্, গ্যাস, টেলিফোন ও পয়োনিষ্কাশনের মতো নগর জীবনের অত্যাবশ্যকীয় প্রতিটি পরিষেবা এখন সেখানে বন্ধ।

গাজার ভবিষ্যত্ তাহলে কোন পথে? ফিলিস্তিনিদের সেখান থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে সেখানে একটি আধুনিক পর্যটন নগরী গড়ে তোলা হতে পারে বলে বাজারে গুজব রয়েছে। গাজায় সামরিক হামলা শুরুর পর সেখানকার বাসিন্দাদের গ্রহণ করার জন্য মিশরকে বারবার অনুরোধ করা হলেও মিশর তাতে সাড়া দেয়নি। তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, পরিস্থিতি হয়তো সেদিকে যাচ্ছে। ইসরায়েল প্রথমে উত্তর গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এরপর অগ্রসর হয়েছে দক্ষিণের খান ইউনিসের দিকে। মনে হচ্ছে যেন গাজাবাসীকে ক্রমাম্বয়ে দক্ষিণে মিশর সীমান্তের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। হতে পারে মিশর এক সময় শরণার্থী হিসেবে গাজাবাসীকে নিতে বাধ্য হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে উত্খাতের বিরোধী। বাইডেন প্রশাসন চায়, হামাস-পরবর্তী গাজা তত্ত্ববধান করবে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ)। বাইডেন ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বিষয়টি জানিয়েছেন। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় ওয়াশিংটন পোস্টের ওপিনিয়ন এডিটোরিয়ালে বাইডেনের এই বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। তখন থেকে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে নেতানিয়াহু এই পরিকল্পনায় রাজি হননি। গাজার ভবিষ্যত্ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মতভেদ থাকলেও বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বাইডেন প্রশাসন এ ব্যাপারে নেতানিয়াহুকে কোনো সীমারেখা টেনে দেয়নি।

আন্তর্জাতিক-এর আরও খবর