যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদের ভবিষ্যৎ কী

  বিশেষ প্রতিনিধি    10-10-2022    186
যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদের ভবিষ্যৎ কী

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরী রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এই আসামিকে ফিরিয়ে আনতে গত প্রায় ১৫ বছর একের পর এক উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। শনিবার (৮ অক্টোবর) বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত বহিঃসমর্পণ চুক্তির বিষয়ে তাগাদা দেওয়ার বিষয়টি জানানো হয়। মানবাধিকারকর্মী ও গণহত্যা বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, রাশেদের রাজনৈতিক আশ্রয় পুনর্বিবেচনাসহ আরও অনেক উদ্যোগের কথা শোনা যায়। কিন্তু তাকে দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের সহযোগিতায় কাজটি করার উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। ৭ অক্টোবর শুক্রবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ওয়াশিংটন ডিসি-তে স্টেট ডিপার্টমেন্টে মার্কিন ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট ওয়েন্ডি আর শেরম্যানের সঙ্গে এক বৈঠকে আবারও বহিঃসমর্পণ চুক্তির বিষয়টি উত্থাপন করেন। প্রতিমন্ত্রী আলম বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বহিঃসমর্পণ চুক্তি সম্পাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে অবিলম্বে ফেরত পাঠানোর জন্য মার্কিন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। প্রসঙ্গত, রাশেদ চৌধুরী ছিলেন ব্রাজিলে। সেখান থেকে ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ২০০৪ সালে দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করে। তারপর থেকে একাধিকবার নেওয়া নানা উদ্যোগেও তাকে ফেরত দিতে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে প্রায় ১৮ বছর আগে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা রাশেদের আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ সরকার অনেক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। সবশেষ ২০২০-এর এপ্রিলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর রবার্ট মিলের কাছে এই অনুরোধ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। পরবর্তীকালে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এই খুনির যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয় মঞ্জুরের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার ঘোষণা দেয় দেশটির বিচার বিভাগ। কিন্তু সেটি আর এগোয়নি। চলতি বছরের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই খুনিকে বাংলাদেশে পাঠানোর ইস্যুতে দেশটির বিচার বিভাগের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তারা জানায়, বিচার বিভাগ ও বিচার বিভাগের হাউজ কমিটিতে রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়টি উত্থাপন করবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে এই তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদন দেওয়া হয় গত আগস্টে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সিনেটর টেড ক্রুজ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য বিশদ তথ্যাদি সরবরাহ করার অনুরোধ করেন। ১০ আগস্ট সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, মো. হাবিবে মিল্লাত, নাহিম রাজ্জাক ও নিজাম উদ্দিন জলিল (জন) এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মানবাধিকারকর্মী ও গণহত্যা গবেষক ড. এম হাসান মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে হলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্টের শরণাপন্ন হতে হবে বাংলাদেশকে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আমেরিকা যে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে বরাবর পিছিয়ে যায়, তার ঐতিহাসিক কারণ আছে। তাছাড়া আমেরিকার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তারা কোনও কোনও ক্ষেত্রে মানবাধিকারের কথা বলে, আবার নিজেরা যেসব জায়গায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট, সেখানে তারা কথা বলে না। ‘ডিনায়াল অব ট্রুথ’ ও ‘ডিনায়েল অব ফেয়ার ট্রায়ালের’ অনন্য উদাহরণ এটি। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ এই পরিস্থিতিটাকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে নেবে না, ততক্ষণ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে না। আমি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে না, কিন্তু কোনও দেশ তাদের বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেবে বা দিবে না, সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘লম্বা সময় ধরে বিচার হয়েছে, রায় হয়েছে। কারা পরিকল্পনাকারী তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়নি। স্পেশাল কমিটি করে তাদেরও শাস্তি হওয়া দরকার।’ কেন যুক্তরাষ্ট্র রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে প্রস্তুত না—প্রশ্নে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটা সমস্যা আছে। এই খুনিরা আইনের আশ্রয়ে আছে। ওখানকার মানবাধিকার সংগঠনগুলো এদের ফেরত পাঠানোর বিরোধিতা করে। কারণ, এরা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ফলে বাংলাদেশের জন্য ফেরত আনা বেশ জটিল। এটা সরকার একা চাইলে হবে না। শক্ত লবিং করতে হবে এবং সেখানে প্রবাসী বাঙালিদের যুক্ত করতে হবে। কেননা, তারা ওখানে ভোটার। কংগ্রেসে ইন্ডিয়ান লবি আছে, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে এই বোধ দিতে হবে যে তোমরা এভাবে আশ্রয় দিলে এই ভূখণ্ড খুনিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠবে। আমরা বরাবরই বলি, অ্যাগ্রেসিভ ডিপ্লোমেসি দরকার। তবেই হয়তো তাদের ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত হবে যুক্তরাষ্ট্র।’ উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে প্রথমবারের মতো ওই ঘটনায় মামলা দায়ের হয়। ১৯৯৮ সালে হত্যার দায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০০ সালে হাইকোর্ট ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০০৯ সালে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখলে আসামিরা রিভিউ আপিল করেন। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রিভিউ আপিল খারিজ করা হয় এবং পরদিন ২৮ জানুয়ারি পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ১০ বছর পর ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। ২৪ বছর তিনি ভারতের কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১২ খুনির একজন আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান।

সারাদেশ-এর আরও খবর