নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বার্মিজ গরু পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে!

  বিশেষ প্রতিনিধি    06-02-2023    207
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বার্মিজ গরু পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে!

বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত শহর কক্সবাজারের টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ জেটি ও পার্বত্য আলীকদম-লামা ও চকরিয়া দিয়ে গরু (বার্মিজ) এনে পাচার করা হলেও পথ পাল্টেছে পাচারকারীরা।

বর্তমানে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নকে পাচারের জন্য নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে তারা। সরকার যেখানে বাইরে থেকে গরু আনাকে নিরুৎসাহিত করছে সেখানে প্রতিনিয়তই এসব জায়গা দিয়ে শত-শত গরু প্রবেশ করছে অবাধে।

গত ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, গবাদি পশুতেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। যত বারই তিনি ভারত সফর করেছেন, সেখানকার সরকার বলেছে তোমাদের গরু দেব না।

মন্ত্রী বলেন, আমি বলি, আপনারা গরু দেয়া বন্ধ করে দিলেই বরং আমরা কৃতজ্ঞ থাকব। আমরা গবাদিপশুতে প্রায় স্বনির্ভরশীল। এর মধ্যেই মিয়ানমার হয়ে গরু প্রবেশ করছে।

এদিকে, মাঝেমধ্যেই নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন, বিজিবি ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে গরু আটক করছে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে পাচারকারীরা।

অন্যদিকে, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ও বাইশারি ইউনিয়নের অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক নেতা গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এছাড়াও গরু পাচারের সময় ইয়াবার মতো মাদকও প্রবেশ করছে দেশে। এর ফলে সরকার একদিকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে মাদক বিস্তারেরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওপারে মিয়ানমারের গরু পাচারকারীরা অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত। এ কারণে তাদের কাছে কেউ যেতে সাহস করে না। কারণ, এই চোরাচালান চক্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত মিয়ানমার সরকারবিরোধী তিনটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপ। গ্রুপ তিনটি হচ্ছে আরাকান আর্মি, আরসা ও আরএসও। এই তিনটি সশস্ত্র গ্রুপের কর্মকাণ্ড পরিচালনা ব্যয়ের একটি বড় অংশই আসে এই চোরাচালান থেকে অর্জিত অর্থ থেকেই। যার কারণে প্রশাসনও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে।

বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী সদর ইউনিয়নের কম্বোনিয়া, জারুলিয়াছড়ি, ফুলতলী, আশারতলী, জামছড়ি, চেরারকুল, চাকঢালা, নিকুছড়ি ও বাইশারির ঈদগড়, আলীক্ষ্যং এবং কাগজী খোলাসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের গরু পাচার হচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছে, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আফছার ইমন, বাইশারি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলম, রামু কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু নোমান গরু পাচারে জড়িত রয়েছেন।

এছাড়াও গিয়াসউদ্দিন, আতাউল্লাহ, জহির, আলী হোসেন, ছাহ্লা, নুরুল ইসলাম, আবদুল গফুর, নুরুল, ফকির আলম, নজরুল, কচ্ছপিয়ার জসিম, জহির উদ্দিন, আবুল কালাম, এম সেলিম, আবদুর রহিম ও লামা ফাসিয়াখালির আওয়ামী লীগ নেতা কুতুব উদ্দিন মেম্বার এ ব্যবসা করছেন। আবার অনেকে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পাচারে সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন নিচ্ছে।

আরো অভিযোগ রয়েছে, পাচারকারীদের মধ্যে কুতুব মেম্বার, রামুর কচ্ছপিয়ার জহির ও জিয়াবুলসহ বেশ কয়েকজন তাদের নিজস্ব খামারে দেশীয় গরুর পাশাপশি মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা গরু এনে জমা রাখে। পরে তা সুযোগ বুঝে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই তারা তাদের খামার থেকে গরু পাচার করে আস?ছে।

এছাড়াও অনেক সময় আটক হওয়া গরুগুলো পাচারকারীরা নিজেরা মিলে সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে বাজার দরের তুলনায় অনেক কম দামে কিনে নেয়। এখানেও ভাগবাটোয়ারার বিষয় থাকে।

এ বিষয়ে বাইশারী ইউপি চেয়ারম্যান মো. আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বাইশারি থেকে বেশ দূরের সীমানা পথ দিয়ে বার্মিজ গরুগুলো তার এলাকা ঘেঁষে পার হয়।

এগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, আমার উপস্থিতিতেই গত ১২ জানুয়ারি পুলিশ অভিযানে ১৯টি গরু জব্দ করে। এর আগেও গরু জব্দ করা হয়েছে।

গরু পাচারের সঙ্গে তার নাম জড়িত থাকার বিষয়ে এ জনপ্রতিনিধি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিংসা পরায়ণ হয়ে এ ধরনের কাজগুলো করছে। গরু পাচারে সম্পৃক্ততা থাকলে কখনোই গরু জব্দ করতে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতাম না।

পাচারের অভিযোগ সম্পর্কে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আফছার ইমন বলেন, আমার আওতাধীন এলাকার চেয়ে বাইশারি ইউনিয়ন অনেক বেশি সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় সেখান দিয়ে কিছু গরু প্রবেশ করছে। তবে গহীন বন এলাকা হওয়ায় তেমন একটা ব্যবস্থা নেয়া যায় না।

তবে তিনিও গরু পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এমনটা ছড়াচ্ছে। এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। সমস্ত বিষয় পরীক্ষা করেও কেউ এমন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবে না।।

একই অভিযোগের বিষয়ে রামু কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু নোমান বলেন, এমন অভিযোগ পুরো ভিত্তিহীন। আমি ঠিকাদার ও কাঠ ব্যবসায়ী। গরু পাচারের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানান তিনি।

এদিকে, একই অভিযোগের বিষয়ে লামা ফাসিয়াখালির আওয়ামী নেতা কুতুব উদ্দিন মেম্বারের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

নাইক্ষ্যংছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) টানটু সাহা বলেন, সীমান্ত বিষয়টি বিজিবির নজরদারীতে থাকে। তবে এর পরেও যখনই থানা পুলিশের নজরদারীতে এমন বিষয় আসে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। গরু বা মাদক পাচারসহ অন্যন্য যে কোন অপরাধ দমনে আমরা ‘শূন্য সহিষ্ণু’ নীতিতে কাজ করছি।

সারাদেশ-এর আরও খবর