কোম্পানির লোভনীয় অফারে স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও সপরিবারে তামাক চাষ

  বিশেষ প্রতিনিধি    03-03-2024    59
কোম্পানির লোভনীয় অফারে স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও সপরিবারে তামাক চাষ

কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় কুষ্টিয়ার চাষিরা সপরিবারে তামাক চাষ করছেন। তারা ধান, গম বা ভুট্টা চাষ কমিয়ে তামাক চাষের প্রতি বেশি ঝুঁকছেন। জেলার দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলার চাষিরা তামাকের খেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফা লাভের আশায় তামাকের কাজ করছেন নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরা।

তামাক কোম্পানিগুলোর আর্থিক সহযোগিতা, বিনামূল্যে বীজ, ঋণে সার ও নগদ অর্থসহ তামাক ক্রয়ের নিশ্চয়তার কারণে তামাক চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হলেও তামাক কোম্পানির লোভনীয় আশ্বাসের কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। কৃষকদের তামাক চাষের কুফলগুলো বোঝাচ্ছেন এবং তামাকের বদলে অন্যান্য ফসল চাষের পরামর্শ দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, কুষ্টিয়ার ৬ উপজেলার মধ্যে দৌলতপুর, ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ করা হয়। অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও তামাক চাষ হয়ে থাকে। ২০১৯-২০ সালে দৌলতপুর, ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলায় তামাক চাষ হয়েছিল ১০ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে। পরের বছর ২০২০-২১ সালে তামাক চাষ হয়েছিল ১০ হাজার ১৯২ হেক্টর জমিতে, ২০২২-২২ সালে ১১ হাজার ৯২০ হেক্টর, ২০২২-২৩ সালে ১০ হাজার ৭৭১ হেক্টর এবং চলতি বছরে ১০ হাজার ৯৩১ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে দৌলতপুর উপজেলায় ৩ হাজার ৬৯৬ হেক্টর, ভেড়ামারায় ৭৮০ হেক্টর এবং মিরপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৪৫৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। যা বর্তমানে চলমান রয়েছে। মিরপুর উপজেলায় কৃষি জমি ২৩ হাজার ১১১ হেক্টর, ভেড়ামারায় ১০ হাজার ৮৯১ হেক্টর এবং দৌলতপুর উপজেলায় কৃষি জমি রয়েছে ৩২ হাজার ৪৪৮ হেক্টর।

জেলার দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তামাক ক্ষেত। ক্ষেতে কেউ তামাকগাছের পরিচর্যা করছেন, কেউ নষ্ট পাতা কাটছেন। আবার কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তামাক ক্ষেতে সার দিচ্ছেন। কেউ কেউ তামাকের পাতা মাঠ থেকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন, কেউ তামাক শক্ত লাঠির সঙ্গে বাঁধছেন। তামাক পোড়ানো ও প্রক্রিয়াজাতের কাজ করছেন নারী, বৃদ্ধা ও শিশুরা।

এদিকে প্রান্তিক কৃষকরা জমিতে তামাক পাতা তোলা ও পোড়ানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বসত বাড়ির আশপাশ ও রাস্তার দুই পাশে তামাক পোড়ানোর ঘর তৈরি করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে এলাকার শিশু-কিশোররা। বীজ, সার ও অগ্রিম ঋণসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় ইরি-বোরো ও রবিশস্যের পরিবর্তে তামাক চাষকেই অধিক লাভজনক মনে করছেন এখানকার কৃষকরা।

দৌলতপুর উপজেলার বালিয়াশিশা এলাকার তামাক চাষি শাহীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণ খাটুনি। স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়। স্বাস্থ্যের ক্ষতি জেনেও রাতদিন পুরুষ, নারী ও শিশুরা কাজ করে। তামাকের সময় বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তামাক চাষে লাভ বেশি। প্রতি বিঘায় প্রায় এক লাখ টাকার তামাক বিক্রি হয়। প্রতি বিঘায় ৫ হাজার চারা লাগানো যায়। বিঘায় ১০ মণ শুকনো তামাক হয়। প্রতি কেজি শুকনো তামাক বিক্রি হয় প্রায় ২০০ টাকায়। খরচ হয় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। লাভ হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। তামাকের আবাদ তিন মাসে হয়ে যায়।

দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলার কয়েকজন কৃষক কামাল, মহিবুল, হযরতসহ বেশ কয়েকজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তামাক চাষে উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ বেশি। ভালো দাম পাওয়া যায়। তাই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও তামাক চাষ করে। বেশি লাভ হওয়ায় চাষ বন্ধ করতে পারছেন না কৃষকরা। আর বোরো ধান চাষে খরচ অনেক বেশি। তাই অনেকে তামাক চাষে ঝুঁকছেন।

তারা আরও বলেন, তামাক চাষের কাজ পরিবারে সবাই মিলে করে। তুলনামূলক অন্যান্য ফসলের চেয়ে লাভ বেশী। তামাকপাতা বিক্রির জন্য বাজারে বাজারে ঘুরতে হয় না। সহজেই তামাকপাতা বিক্রি করা যায়। এই এলাকায় বহুকাল ধরে তামাক চাষ হয়। তামাক কোম্পানির লোকজন বাড়িতে এসে তামাক বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়। তামাক চাষ করার জন্য চাষিদের উৎসাহিত করেন। তাদের মধ্যে অগ্রিম ঋণে কার্ডের মাধ্যমে তামাকের সার ও বীজ সরবারহ করে থাকেন। ফলে তামাক চাষ বেড়েই চলেছে।

দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি ইউনিয়নের তামাক চাষিরা বলেন, চাষিদের সুবিধার জন্য কোম্পানিগুলো বিভিন্ন এলাকায় অনেক বড় বড় ক্রয় কেন্দ্র ও গোডাউন তৈরি করেছে। তামাক ক্রয়ের জন্য ঢাকা ট্যোবাকো, আবুল খায়ের ট্যোবাকো, নাসির ট্যোবাকো, আকিজ ট্যোবাকোসহ বেশ কয়েকটি তামাক কোম্পানি রয়েছে। কোম্পানির সুপারভাইজার ও কর্মকর্তারা চাষিদের উৎসাহ ও সুবিধা দেন। তামাক কোম্পানির কর্মীরা প্রতিদিন মাঠে গিয়ে চাষির সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কখনও অন্য ফসল উৎপাদনের জন্য এধরনের এতো উদ্যোগ দেখা যায় নি। এসব কারণেই কৃষকরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে তামাকের চাষ হয়। তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ যথেষ্ট আন্তরিক ও তৎপর। মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে ধান, ভুট্টা, গম, আলুসহ ফল চাষে নানা পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কৃষকদের সরকারি প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কৃষকরা সচেতন হলে তামাক চাষ থেকে বেরিয়ে আসবেন।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হয়। দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তৌহিদুল হাসান তুহিন বলেন, তামাক স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তামাকের গুঁড়া বাতাসের সঙ্গে মানুষের শ্বাসনালি দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। তামাক ফুসফুসের ক্ষতি করে। এই তামাকের কারণে মানুষের ব্রংকাইটিস, এজমা, টিবিসহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে। এধরণের রোগীরা অনেকেই তামাক উৎপাদন বা তামাকের কাজ করে। তামাকের কাজ করলে রোগে আক্রান্ত হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না।

সারাদেশ-এর আরও খবর